Thursday, March 29, 2018

শুনলে রামকৃষ্ণ-কথা জীবন জুড়ায় এমনি মিঠে।
পাষাণে জল ঝরে ভাই মরা গাছ মঞ্জুরে উঠে॥

পাঠক ও প্রবোধ - এঁরা দুজন রঙ্গালয়ের অভিনেতা, গিরিশ ঘোষকে গুরু বলে জানেন। রঙ্গালয়ে যখন 'চৈতন্যলীলা' অভিনীত হয়, তখন থেকে এঁরা রঙ্গালয়ে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে দর্শন করেছেন। তাঁর শ্রীপদরজঃ গ্রহণ করেছেন এবং মহাপ্রসাদ ধারণ করেছেন।

পাঠক। দেখ, প্রবোধ, সকল রকম নেশা করলুম - যখন একটা নূতন নেশা ধরা যায়, তখন দিন কয়েক বেশ মজা থাকে, তারপর নেশাটার ধার মুড়ে যায়, কাজেই আবার একটা নূতন নেশা ধরতে হয়। এ রকম করে সব নেশাই তো ফেল হলো, বাকি ছিল গাঁজাটি, তাও বুঝি যায় যায়।

এই বলে ধূমপান ও কথোপকথন চলল। কথা চলতে চলতে পরমহংসদেবের কথা পড়ল।

পাঠক। দেখ, ভাই, সেই যে পরমহংস ঠাকুর - গিরিশবাবু যাঁকে গুরু গুরু বলেন - তিনি বেশ লোক, আচ্ছা সাধু। সাধুদের যেমন জটাফটা থাকে, গেরুয়া কাপড় থাকে, গায়ে ছাই মাখা থাকে, এঁর তা কিছু নেই। আর একটি দেখেছ - সাধুর কোন অহঙ্কার নেই। তিনি আগেই লোককে নমস্কার করেন। চেহারাটি কেমন! - ঠোঁট দুটি ঈষৎ রাঙা রাঙা, চোখ দুটি বাঁকা বাঁকা, মুখখানি ঢল ঢল, আবার তারই মধ্যে একটি জুলুস আছে। দেখলেই মানুষের মনটি

তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে। কথাগুলি কেমন মিষ্টি! গলার সুর কেমন মিষ্টি! এমন সুন্দর গান তো, ভাই, কখনো শুনিনি। আমাদের থিয়েটারে কত ভাল গাইয়ে রয়েছে এবং আগেও কত ছিল। সকলেরই তো গান শুনেছি, কিন্তু এমন কেউ গাইতে পারেনি। এখন পরমহংস ঠাকুরের সকলেই সুখ্যাতি করে।

প্রবোধ। আর একটা পরমহংস ঠাকুরের গুণ আছে, তা জানিস? শুনেছি, উনি দক্ষিণেশ্বরে রানী রাসমণির কালীর পূজারী ছিলেন। কালীর পূজা করতে করতে মা সদয়া হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। উনি যখন মনে করেন, ডাকলেই তখুনি মায়ের দেখা পান, মায়ের সঙ্গে কথা হয়। সেই থিয়েটারে একদিন অভিনেত্রীদের দেখে 'মা আনন্দময়ী, মা আনন্দময়ী' বলে মূর্ছা গেলেন, আর খানিক বাদে বিড় বিড় করে কি বলতে লাগলেন।

পাঠক। ও মূর্ছা নয়, ওকে সমাধি বলে, আর ঐ যে বিড়বিড়ানি ওটা মায়ের সঙ্গে কথা। শুনেছি, উনি সব জানতে পারেন, মা সব বলে দেন। লেখাপড়া জানেন না, কিন্তু বড় বড় পণ্ডিত হেরে যায়।

প্রবোধ। আচ্ছা, ভাই, লেখাপড়া জানেন না, তবে কি করে পণ্ডিতদের হারিয়ে দেন?

পাঠক। মায়ের সঙ্গে যাঁর কথা হয়, তিনি লোকখানা কি! ওঁকে পণ্ডিতদের সঙ্গে বেশি কথা কইতে হয় না; কি হয় শুন - পণ্ডিতগুলো দূর থেকে লম্ফঝম্প করে আসে, প্রথমে রোক করে খুব তর্কবিতর্ক করে, তারপর যখন বড় বাড়াবাড়ি হয়, তখন ঐ পরমহংস ঠাকুর ছুঁয়ে দেন - আর পণ্ডিতগুলোর ভ্যাবাচাকা লেগে যায়।

প্র। তারপর?

পা। তারপর আর কি - সে তর্জন-গর্জন করা দূরে থাক, কেউ

হাতজোড় করে স্তব করে, কেউ পায়ে লুটে পুটে, কেউ বলে 'আমাকে চৈতন্য দাও', কেউ কাঁদে, এ রকম আর কি!

প্র। আচ্ছা, ভাই, একটা কিছু দেখে তো অমন করে। ছুঁয়ে দিলে কি দেখে কিছু শুনেছ?

পা। হাঁ, শুনেছি - কেউ শিব দেখে, কেউ কালী দেখে, কেউ রাম দেখে, কেউ কৃষ্ণ দেখে আবার কেউ যে কি দেখে, তা কিছু বলতে পারে না! কত লোক ঐ লোকটির কাছে কাবু হয়ে গেছে! এই দেখ না, আমাদের চোখের উপর গিরিশবাবু কি হয়ে গেলেন! গিরিশবাবু তো একটা সহজ লোক নন! লোকটি কারও কাছে মাথা নোয়ান না। মেসো, পিসা, মামা ইত্যাদি গুরুজনকে নমস্কার করতে হবে বলে আত্মীয় লোকের বাড়ি যান না। ঘোর নাস্তিক। বাঘে ধরে খেতে আসে, তবু ভগবানের নাম মুখে আনেন না। সাধু-সন্ন্যাসী দেখলেই চটে যান, ঠেঙা উঁচিয়ে রাখেন। দেবদেবীর প্রতিমা কাটারি দিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটেন। সব জানিস তো - ঐ পরমহংস ঠাকুরকে প্রথম প্রথম থিয়েটারে কত গাল দেওয়া হলো। তারপর পরমহংস ঠাকুর সেই আপনার মন্তর ছেড়ে ছুঁয়ে দেওয়া মাত্র গিরিশবাবু - কাবু। এখন গিরিশবাবুই তাঁকে ভগবান বলেন।

প্র। আচ্ছা, ভাই, আর কেউ এমন হয়েছে জানিস?

পা। হাঁ, সেদিন শশধর তর্কচূড়ামণি বক্তৃতায় শহরকে তোলপাড় করে দিলেন। যে তাঁর বক্তৃতা শোনে, সে-ই বাহবা দেয়। আজ এখানে বক্তৃতা, কাল সেখানে বক্তৃতা, একটা হুলস্থূল পড়ে গেল। তারপর ঐ পরমহংস ঠাকুর তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা করে তাঁকে ছুঁয়ে দিয়ে কি বললেন!

প্র। তারপর?

পা। তারপর আর কি - যেমনি ছোঁয়া, অমনি বোবা হওয়া! সেই

শশধর পণ্ডিত কতদিন পরমহংস ঠাকুরের পেছু পেছু ঘুরলেন, কি দেখলেন, এখন আর সাড়াশব্দ নেই।

প্র। আর কারও কথা জানিস?

পা। ঢের ঢের অনেক - সময়ে আবার বলব।

প্র। তুই এত কোথা থেকে শুনলি?

পা। ওরে ভাই, আজকাল যেখানে যাই, সেখানেই ঐ পরমহংস ঠাকুরের কথা।

প্র। এখন ঐ ঠাকুর কোথায়?

পা। শুনেছি, তিনি এখন কাশীপুরের একটি বাগানবাড়িতে আছেন। তাঁর গলায় বেদনা হয়েছে, তাই তাঁর ভক্তেরা সেখানে তাঁকে রেখে চিকিৎসা করাচ্ছেন। ব্যারাম বড় শক্ত। শুনেছি, শহরের ডাক্তার কবিরাজ সব হার মেনে গেছেন। ডাক্তার মহেন্দ্র সরকারও কিছু করতে পারেননি।

প্র। চল্, এখন সেই পরমহংস ঠাকুরকে দেখে আসি। ব্যারাম এমন শক্ত হয়েছে, শুনে প্রাণটা কেমন করে উঠল!

পা। আমারও ভাই। তবে চল্।

দুজনে পথে বের হলো। এখন বেলা প্রায় দুপুর পেরিয়ে গেছে; খানিক দূরে গিয়ে দুজনেরই ক্ষুধা পেল।

প্র। ভাই, খিদেয় আর চলা যায় না, দেড় ক্রোশের উপর পথ। সঙ্গে দুজনের মধ্যে কারও একটা পয়সা টেঁকে নেই। যখন বেরিয়ে এসেছি, তখন যাই হোক যাব। তুই যে আগে বললি, পরমহংস ঠাকুর আরও অনেক লোককে ছুঁয়ে দিয়ে বোবা করে দিয়েছেন, তাদের কথা বলবি। কই, এখন বল না। দেখ, ঐ ঠাকুরটি যেমন সুন্দর, তাঁর সম্বন্ধে কথাগুলিও তেমনি।

পা। আমি সেদিন বাবু দত্তের গুলির আড্ডাতে গিয়েছিলেম,

সেখানে অনেকেই ঐ পরমহংস ঠাকুরের কথা বলছিল। কথাগুলি শুনতে বেশ লাগল। একজন বললে, কেশব সেন এত চেলা করলেন, বিলাতে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে বড় বড় সাহেবকে মোহিত করলেন, এখানে ভারতবর্ষে কত ব্রাহ্মমন্দির স্থাপন করলেন; তাঁর বক্তৃতায় এমন জোর যে, মানুষ শুনলেই তাঁর বশীভূত হয়ে যায়। তোমাদের মনে আছে - সেই বিডন গার্ডেনে যেদিন বক্তৃতা হলো, এত বড় বাগানটার বাইরে ভিতরে লোক আর ধরে না, শহর তোলপাড়। তারপর পরমহংস ঠাকুরের সঙ্গে কেশববাবুর দেখা হয়।

প্র। দেখা হয়ে কি হলো?

পা। সে লোকটি বললে, দিন কতক পরমহংস ঠাকুরের সঙ্গ করতেই কেশববাবুর মোড় ফিরে গেল - সে কেশব বদলে আর এক কেশব হয়ে গেলেন! নিজের শিষ্যদিগকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে যাওয়া-আসা করতে লাগলেন। কখনো কখনো পরমহংস ঠাকুরকে নিজের ঘরে আনতেন। এ রকম হতে হতে কেশব সেনের সে বক্তৃতার চোট কোন্ দিকে উড়ে গেল, আর মুখটি বুজে পরমহংস ঠাকুরের পা-তলাটিতে বসে তিনি কি বলেন, সে-সব শুনতেন। একদিন পরমহংস ঠাকুর কেশববাবুকে বলেছিলেন, 'কেশব, তুমি কেমন বক্তৃতা কর, কিছু বল না?' তাতে কেশববাবু জবাব দেন, 'মশায়! কামারঘরে কি ছুঁচ বিক্রি?'

প্র। কি আশ্চর্য! একজন কালীর পূজারী বামুন, মোটে লেখাপড়া জানা নেই - তাঁর কাছে কেশববাবুর মতো এত বড় একটা লোক এমন হয়ে গেলেন! এ তো শহরে হাজার হাজার পূজারী বামুন, ভটচায, টোলের অধ্যাপক রয়েছেন, সংস্কৃত বোল আওড়িয়ে দিক আঁধার করে দেন। কই, এমন তো কেউ নয়, আর কোথাও আছে তাও তো শুনিনি।

পা। তুই তো নিজেই বললি এ খানিক আগে যে, তোকে কে বলেছিল - পরমহংস ঠাকুর কালীর পূজারী ছিলেন। তাঁর পূজায় মা খুশি হয়ে তাঁকে দেখা দিয়েছিলেন আর ডাকলেই মা আসেন আর তাঁর সঙ্গে কথা হয়। মা-কালীর সঙ্গে যাঁর কথাবার্তা হয়, তাঁর সঙ্গে আবার কি কারও তুলনা আছে? ঈশ্বর-জানিত লোক!

প্র। আচ্ছা, পরমহংস ঠাকুর মা-কালীর পূজা করতে করতে মা-কালীর দেখা পেলেন - আর এ শহরের ভেতরে এত কালীমূর্তি রয়েছে, সব জায়গাতেই পূজারী বামুন রয়েছে - মাকে বেশ সাজায়, বেশ ভোগ দেয়, তারা এমন না হয়ে অন্য রকম হয় কেন বল দেখি? কালীঘাট তো একটি পীঠস্থান - মা জাগ্রতা, সেখানকারও তো খবর জানি।

পা। যে যা চায়, সে তাই পায় - পরমহংস ঠাকুর মায়ের পূজার জন্য পূজারী হয়েছিলেন, মা-কালীর দর্শন পাবার আশায় তাঁর পূজারী হয়েছিলেন, মায়ের সঙ্গে কথা কইবার জন্য পূজারী হয়েছিলেন, তাই মা-কালী তাঁর পূজা নিয়েছেন, তাঁকে দেখা দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে কথা কয়েছেন এবং ডাকলেই এসে কথা কন। আর এঁরা উপরে ভক্তিযুক্ত হলে কি হবে, এঁরা তো আর পূজারী নন - পূজার অরি। মাও তেমনি পূজা নেন, আর মায়ের চরণলাভ, কি মায়ের সঙ্গে কথাবার্তার বদলে যা চান - চালকলা, তাই লাভ হয়। আর যাঁরা পূজা দেওয়ান তাঁদের সঙ্গে (দক্ষিণার খাতিরে) কথাবার্তা হয়ে পূজাকাণ্ড শেষ হয়।

প্র। তুই, ভাই, এত বুঝলি কি করে? এক সঙ্গেই তো এত কাল রয়েছি - কই আমি তো কিছু বুঝতে পারিনি।

পা। আমিও কিছু বুঝতেম না, তবে যেদিন পরমহংস ঠাকুর থিয়েটারে ডান পা-টি বাড়িয়ে দিয়ে সমাধিস্থ হলেন, আর গিরিশবাবু

চেঁচিয়ে বললেন, 'আয় কে কোথায় আছিস, শীঘ্র পায়ের ধুলো নে', আমি তাড়াতাড়ি এসে পায়ের ধুলো নিলুম আর বললুম (সে সময় চোখে একফোঁটা জলও এল), 'ঠাকুর, কৃপা কর।' তারপর থেকে আমি কেমন একটু একটু বুঝতে পাচ্ছি, আর আমাকে একটা কেমন কেমন করেছে! আমি দেখেছি, এ ঠাকুরেরই কৃপায় বুঝতে পাচ্ছি। আর একটা মজা, যত এ ঠাকুরের কথা শুনি বা বলি - যা আমি কখনো জানতুম না, তাও আমি বুঝতে পারি।

প্র। ঐ যে বললি আমাকে কেমন কেমন করেছে - ওর মানে কি? তোকে কি করেছে? তোর কি হয়েছে - ভেঙে বল।

পা। আমি ঐ যা বলেছি, ওর বেশি কিছু আর বলতে পারব না। তবে কেমন জানবি - যেমন খুব ঘুমিয়েছিলুম, এখন ঘুমটা ভাঙা ভাঙা।

প্র। আমি তোর কথা কিছু বুঝতে পারিনে - হ্যাঁ, ভাই, কি করে তোর মতো বুঝতে পারব।

পা। চল, এই তো সেই ঠাকুরের কাছে যাচ্ছি। আমিও আবার কিছু মাগব, তুইও কিছু মাগিস।

প্র। আমি কি মাগব, কিছু বুঝতে পাচ্ছিনে; তুই বলে দে।

পা। যাঁর কাছে যাচ্ছিস, তিনিই বুঝিয়ে দিবেন, মাগিয়ে দিবেন।

এমনি রামকৃষ্ণদেবের মহিমা - তাঁর কথার এমনি মহিমা! প্রবোধ ও পাঠক যত ঠাকুরের কথা বলছে, ততই তাদের চৈতন্যোদয় হচ্ছে এবং ঠাকুরের লীলার ভিতর বুদ্ধি প্রবেশ করছে। রামকৃষ্ণ নামই মহামন্ত্র - রামকৃষ্ণ কথার আন্দোলনই সাধন-ভজন। লীলাকথা কীর্তন করতে করতেই জীবের চৈতন্যোদয় হয়। কাঠে কাঠে ঘর্ষণ করলে যেমন সর্বভুক অগ্নির উৎপত্তি হয়, ঠিক সেই প্রকার রামকৃষ্ণকথা আন্দোলন করতে করতে তমোনাশী চৈতন্যের উদয় হয়।

প্র। তুই যে বললি, পরমহংস ঠাকুরের সঙ্গ পেয়ে কেশববাবুর মোড় ফিরে গেল, ওটা কি বুঝতে পারলেম না - ভেঙে বল দেখি।

পা। যে লোকটি ঐ কথা বলেছিলেন, আমিও তোর মতো বুঝতে না পেরে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলুম। তিনি যা বললেন, আমিও ভাল বুঝতে পারিনি। বললেন, কেশববাবু আগে নিরাকার নিরাকার করতেন, এখন মা মা করেন। এর মানে - কেশববাবু নিজের ইচ্ছামত একটা পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, পরমহংস ঠাকুর দেখলেন - গন্তব্য স্থানে যেতে হলে এটা ঠিক পথে যাওয়া হচ্ছে না, অমনি কেশববাবুকে ঠিক পথে চালিয়ে দিলেন।

প্র। কথাটা আরো একটু ভেঙে বল দেখি।

পা। শোন, একটা উপমা দিয়ে বলি। যেমন একখানা নৌকা, তার মাঝি নেই, আর খুব ঝড় দিয়েছে। নৌকাটা দিক-বিদিক মানছে না, যে দিকে ঝড়ে নিয়ে যাচ্ছে, সে দিকেই ছুটে যাচ্ছে - তাতে চড়ায় লেগেই হোক, আর শক্ত জায়গায় লেগেই হোক, ধাক্কা খেয়ে ভেঙে ডুবে যাবে, তা নিশ্চয়। এমন সময় যদি একজন পাকা মাঝি সেই নৌকায় টপ্ করে ওঠে, তাহলে মাঝিটি কি করে? মাঝিটি অমনি হালটি ধরে ঠিক পথে চালিয়ে নিয়ে যায়। কেশববাবু খুব অনুরাগী লোক, ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন; ঠাকুর ঠিক পথটি দেখিয়ে দিলেন এবং সেই দিকে চালিয়ে দিলেন।

ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব গলায় বেদনাহেতু প্রায় দশ মাস অন্ন খেতে পারেননি। সেবকরা পানীয়রূপে তরল দ্রব্য খেতে দিতেন। এখন তাও খেতে পারেন না; যা মুখে দেন তার অধিকাংশই মুখ থেকে পড়ে যায়, যৎকিঞ্চিৎ উদরগত হয়; তাই সেবকরা খাওয়াবার জন্য খাবার কিছু বেশি করে করেন। আজ বেদনা বাড়াবাড়ি - নামমাত্র মুখে দিয়েছেন; সম্মুখে পাত্র সব পড়ে আছে।

ঠাকুর দ্বিতলে যে ঘরে আছেন তার সকল দরজা জানালা বন্ধ। যেখানে তাঁর শয্যা সেটি অতি নিভৃত স্থান। এখানে মানুষ থাকলে বাগানের মধ্যে নিচে কে আসছে যাচ্ছে কিছুই জানা যায় না। ভক্তবৎসল ঠাকুর কিন্তু জানতে পেরেছেন যে, প্রবোধ ও পাঠক দর্শনের জন্য এসেছে, আর তাদের বড় ক্ষুধা পেয়েছে। অমনি ঠাকুর একজন সেবককে বললেন, "দেখ্, যে দুটি লোক এইমাত্র নিচে এল, তাদের শীঘ্র ডেকে নিয়ে আয়।" সেবক আজ্ঞামত সেই ভাগ্যবান দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরের ঘরের দরজায় প্রবেশ করতে না করতে ঠাকুর তাদের ঘন ঘন হাত বাড়িয়ে ডেকে বললেন, "আয় আয়, আমি তোদের জন্য খাবার নিয়ে বসে রয়েছি। তোদের বড় ক্ষুধা পেয়েছে, খা খা।" উভয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করে তাঁর চরণরেণু নিয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে মহাপ্রসাদ উদর পূর্ণ করে খেতে লাগলেন।

ভক্তিমান ও হৃদয়বান পাঠক, ছবিটি একবার হৃদয়পটে এঁকে দেখুন। আমার কি সাধ্য যে, কলম কালি দিয়ে এ অপূর্ব লীলাচিত্র আঁকতে পারি! লীলা কি বিচিত্র! নিত্য অপেক্ষা লীলা অতীব সুন্দর। যিনি বাক্যমনের অগোচর, পুরুষপ্রধান, সর্বজ্ঞ, সর্বগ, সর্বানুপ্রবিষ্ট, পূর্ণব্রহ্মসনাতন, অনাদি, অনন্ত, অখণ্ডসচ্চিদানন্দ, তিনিই তাঁর মর্ত রঙ্গালয়ে আজ কাশীপুরের বাগানে কতিপয় ভক্তসঙ্গে জগতের চক্ষে ধুলো দিয়ে রামকৃষ্ণলীলার শেষাংশটি অভিনয় করছেন। অঙ্গের সাজ - দীনতা, হীনতা, জীবহিতার্থে অপার করুণা। শরীরটি জীর্ণশীর্ণ কঙ্কালসার। বাক্যমনের অগোচর হয়েও জীবকে শিক্ষা দেবার জন্য ঠিক তাদের মতো নিজে কি, তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন; দীন দুঃখীর সাজটি মাত্র, কিন্তু রাশি রাশি দেবেশ-দুর্লভ রত্নমণি অকাতরে যাকে তাকে বিতরণ করছেন। প্রবোধ ও পাঠককে লয়ে তিনি আজ যে

১০

খেলাটি করলেন, তা শুনে কোন্ পাষাণ প্রাণ না গলবে? দেখুন দয়ার তুলনা বা পরিমাণ আছে কি? দেখুন দেখি ঠিক সেই পতিতপাবন বটেন কিনা! জগদীশ্বরকে সর্বশক্তিমান জেনেও মানুষ যে কোন্ বুদ্ধিতে অবতারবাদের প্রতিবাদ করে, তা এ বুদ্ধিতে বুঝতে পারলুম না - সে বুদ্ধিকে নমস্কার।

রামকৃষ্ণদেবের আনন্দময় মূর্তি। হাজার বদ্ধজীব হোক না কেন, যতক্ষণ তাঁর কাছে থাকে ততক্ষণ সে আনন্দসাগরে ভাসতে থাকে, কখনো ডুবে থাকে। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের তাপনিবারণ-মহিমা আমরা বরাবর দেখেছি।

পাঠক ও প্রবোধ পরমানন্দে উদর পূর্ণ করে প্রসাদ গ্রহণ করলেন। পরে ঠাকুরের কাছে বিদায় নেবার সময় চোখ ছলছল - জোড়হাতে বললেন, "ঠাকুর, আপনার চরণে যেন রতি মতি থাকে।" ঠাকুর চুপ করে রইলেন আর একটুকু হাসলেন। তাঁর ভুবনমোহন হাসিমুখ ছিল, সেটি দেখলে আর তাঁকে কোন জন্মেও ভুলবার জো নেই, সে হাসিমুখটি দেখালেন। এঁরা পথে ঠাকুরের কথা কইতে কইতে ঘরে এলেন। তারপর অল্প দিনের মধ্যেই তাঁরা শুনলেন - ঠাকুর আর লীলাধামে নেই। শুনে দিন কয়েক হায় হায় করলেন, তারপর থেমে গেলেন।

রামকৃষ্ণদেবের কৃপায় এঁদের পূর্বপ্রকৃতি ক্রমে বদলে যেতে লাগল, সংসারধর্মে আঁট হলো, স্ত্রীপুত্রের উপর কর্তব্যবোধ এল। নেশাভাঙ কমে গেল, রামকৃষ্ণদেবের কথা শুনতে পেলে মন দিয়ে শোনেন, ঠাকুরের ভক্ত দেখলেই ভক্তিশ্রদ্ধা করেন, ঠাকুরের মহোৎসবে যোগ দেন; রামকৃষ্ণদেবের লীলাগুণ গীতচ্ছন্দে বাদ্যযন্ত্রসহকারে অনেকে একত্র হয়ে সমস্বরে কীর্তন করেন; রঙ্গালয়ে সাজঘরে রামকৃষ্ণদেবের ফটো প্রতিমূর্তি রাখেন এবং অভিনয়ের দিন সুন্দর সুন্দর গোছা

১১

গোছা ফুলের মালা দিয়ে সাজান; যতবার সাজঘর থেকে রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করতে আসেন, ততবার ঠাকুরকে প্রণাম করেন, অভিনেত্রীদের ঠাকুরকে ভক্তি করতে বলেন, মধ্যে মধ্যে একসঙ্গে ঠাকুরের গুণের কথা কন। ক্রমে ঠাকুরের উপর ভালবাসা জন্মাল।

এভাবে বার-তের বছর কেটে গেল। এখন তাঁরা দেখলেন, যে ঠাকুরটিকে তাঁরা দেখেছেন, যাঁকে এত ভক্তি করেন, তিনি বড় সোজা ঠাকুর নন, একটা বড় কেউকেটা নন, তাঁর মহিমা দেশবিদেশের লোকদিগকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে; ইংলণ্ড ও আমেরিকা প্রভৃতি বড় বড় জায়গায় রামকৃষ্ণ-নামের পতাকা উড়ছে, দলে দলে সাহেব বিবি ঠাকুরের লীলাস্থল দেখতে আসছে; ইংলণ্ডের সর্বপ্রধান পণ্ডিত তাঁর জীবনী লিখছেন, তাঁর বিষয়ে আন্দোলন করছেন; ঠাকুরের শিষ্যগণ বিশ্ববিজয়ী হয়ে উঠছেন, মানুষ যা করতে পারেনি, সেসব কাজ করছেন। এসকল দেখে শুনে ঠাকুরের লীলাকথা শুনতে তাঁদের বড় ইচ্ছা হলো। একদিন ঠাকুরের শরণাপন্ন একজন ভক্তের সঙ্গে দেখা হওয়ায় তাঁকে বললেন, 'মশায়, আপনি আমাদিগকে ঠাকুরের কিছু কথা শোনাবেন? আমাদের ঠাকুরের কথা শোনার বড় সাধ হয়েছে।' সে-লোকটি থিয়েটারের লোকেদের মধ্যে রামকৃষ্ণ-ভক্তির স্রোত বইতে দেখে তাঁদের কাছে কেঁদে ফেললেন আর বললেন, "দেখ ভাই, আমি মূর্খ, রামকৃষ্ণদেবের মহল্লীলা আমি কেমন করে বলব? তবে তিনি কৃপা করে যা দেখিয়েছেন, যা শুনিয়েছেন বা জানিয়েছেন তা বলব, তোমরা জিজ্ঞেস কর।"

পা। আপনারা যে রামকৃষ্ণদেবকে ভগবান বলেন, সত্যি কি তিনি ভগবান?

ভক্ত। তুমি আগে একটা কথার জবাব দাও, তারপর আমি বলব। তুমি ভগবান কাকে বল? তোমার ভগবান কিরূপ?

১২

পা। ভগবান মস্ত বড়, সর্বশক্তিমান। তিনি মনে করলে সব করতে পারেন - তিনি এই সৃষ্টির, এ দুনিয়ার মালিক। রাম ভগবান, কৃষ্ণ ভগবান। আমি এই বুঝি।

ভ। রামকৃষ্ণদেবও তাই।

পা। কই, আমরা কিছু বুঝতে পারিনি। আপনি বুঝিয়ে দিতে পারেন? রামকৃষ্ণ যে ভগবান, তার প্রমাণ কি?

ভ। প্রমাণ - রামকৃষ্ণলীলাদর্শন ও তাঁর কৃপা। ভগবান যখন অবতার হয়ে আসেন, তখন তাতে একটি লক্ষণ থাকে। সেটি কি তা জান? যে দেহে কোন লক্ষণই থাকে না সেই দেহধারী ভগবানের অবতার। অবতারে কোন লক্ষণই পাওয়া যায় না। অবতার উপলব্ধি ও প্রত্যক্ষের বিষয়। তিনি প্রত্যক্ষ হলে জানতে পারা যায় যে, তিনি লক্ষণাতীত - এই লক্ষণযুক্ত। আমার ধারণা এই।

পরমহংসদেব অবতারের একটি লক্ষণ দিতেন। তা এই: যে দেহে প্রেমভক্তির বন্যা বয়ে যায়, যিনি রাত্রিদিন ঈশ্বরপ্রেমে বিহ্বল, তিনিই দেহধারী ঈশ্বরের অবতার। যতদিন ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ না পাওয়া যায়, ততদিন এই লক্ষণ কেউ বুঝতে পারে না।

আর একটি কথা বলতেন যে, অবতার অচিনে গাছের মতো। একরকম গাছ আছে, তার নাম অচিনে গাছ, তার মানে - কেউ তাকে চিনতে পারেনি। আবার তিনি পাহারাওয়ালার হাতের আঁধারে লণ্ঠনের উপমা দিয়ে বলেছেন যে, তাঁকে চেনাও যায় এবং দেখাও যায়। পাহারাওয়ালা রাত্রিতে গলিঘুঁজিতে পাহারা দেবার জন্য হাতে একটা লণ্ঠন রাখে, তাকে আঁধারে লণ্ঠন বলে। এই লণ্ঠনের এমন একটি গুণ আছে যে, যার হাতে থাকে, সে ঐ লণ্ঠনটি দিয়ে সকলকে দেখতে পায়, কিন্তু তাকে কেউ দেখতে পায় না। তবে যদি পাহারাওয়ালা ঐ লণ্ঠনটি আপনার নিজের দিকে ফিরিয়ে দেয়

১৩

তাহলে তাকে দেখা ও চেনা যায়; সে রকম নরদেহধারী সেই চৈতন্যময় যে শক্তিতে নিজেকে লুকিয়ে রেখে আগোটা সৃষ্টি জীবজগৎ দেখছেন, যদি সেই চৈতন্য আলো দিয়ে নিজেকে দেখিয়ে দেন, তাহলে মানুষ তাঁকে দেখতে ও জানতে পারে। এখানে তোমাদের একটি কথা বলি শোন - অন্যান্য অবতারের মতো রামকৃষ্ণদেবকে চেনা বড় শক্ত। এঁতে তো রজের ঐশ্বর্য নেই, এঁতে আগাগোড়া শুদ্ধসত্ত্বের ঐশ্বর্য। দীন ভক্তভাবে সত্ত্বের ঐশ্বর্য চেনা ও ধরা বড় শক্ত। এখানে তো রাক্ষসবধের ধ্বংসও নেই আর অঘাসুর বকাসুর তাড়কা পুতনাদির বধও নেই। এসব চোখে দেখে, কানে শুনে লোকে একটা বুঝতে পারে, কিন্তু এখানে সত্ত্বের ঐশ্বর্য; এ চোখে কানে দেখা শুনা যায় না - স্বতন্ত্র চোখ-কান চাই। এবার কি হলো জান? এবার ভগবানের ভাণ্ডারের রত্নমণি - যে রত্নমণি অকূল অপার মহাসাগরের জলে লুকানো ছিল, তাই লুঠ হয়ে গেল। রামকৃষ্ণদেব নিজের দেহ দিয়ে অগণ্য দুঃসাধ্য সাধন-মন্থনে সেসব রত্নমণি বের করে মুড়ি-মুড়কির মতো জগতে বিলিয়ে দিলেন। রামকৃষ্ণদেব এখন আমাকে যা দেখিয়েছেন, যা বুঝিয়েছেন, তাতে বেশ দেখতে পেয়েছি এবং বুঝতে পেরেছি যে, তিনিই সেই ভগবান, ভগবানের অবতার, দুনিয়ার মালিক, সর্বশক্তিমান সেই রাম, সেই কৃষ্ণ, সেই কালী, সেই অখণ্ডসচ্চিদানন্দ - মনবুদ্ধির অতীত আবার মনবুদ্ধির গোচর। তোমার আমার পক্ষে তাঁকে জানবার সহজ উপায় - তাঁর লীলাদর্শন।

পা। লীলা শ্রবণই করা যায়। দর্শন করা যায় কি রকমে?

ভক্ত। তুমি যখন একাগ্রমনে ঐ পথে যাবে, তখন আপনিই বুঝতে পারবে। আভাসে কথাটা কেমন জান? একটি সুন্দরীর রূপবর্ণন শুনতে শুনতে একটি ভাবের উদয় হয়, তারপর ঐ ভাব থেকে অন্তরে সুন্দরীর যেমন একটা ছবি ওঠে, তেমনি লীলাকথা শুনতে

১৪

শুনতে লীলার ভাব ফুটে, পরে ভাব থেকে লীলার ছবি ওঠে। ঐ ছবি দেখতে পেলেই বুঝতে পারবে যে, ঐ লীলাটি যাঁর, তিনি কে।

পা। রাম-অবতারে, কৃষ্ণ-অবতারে, কত শত আশ্চর্য ঘটনা আছে, যেমন - কাঠ সোলা হলো, পাষাণী মানুষ হলো, গিরিগোবর্ধন ধরা হলো, কৃষ্ণ কালী হলেন, পুতনা মরল, কংস-বধ হলো, গীতা বললেন। এখানে কি হবে?

ভক্ত। এর চেয়ে অনেক বেশি বেশি হয়েছে। আজ পর্যন্ত কত অবতার হয়েছেন, তাঁরা সকলে মিলে যা করেছেন, রামকৃষ্ণদেব সেসব করে তার উপর আরও কিছু নূতন করেছেন, কিছু বেশি করেছেন। তুমি যেসব অবতারের কথা বললে, তাঁদের লীলাকথা শুনেছ, তাই তাঁদের ভগবান বলে বিশ্বাস হয়েছে। রামকৃষ্ণলীলা শুন, তাহলে রামকৃষ্ণদেব কি বুঝতে পারবে। তোমাদের রামে কৃষ্ণে যখন বিশ্বাস আছে, তখন রামকৃষ্ণলীলা সহজে বুঝতে পারবে। যিনি একটি অবতার বুঝেন, তিনি সব অবতারই বুঝেন। যাঁর একটিতে বিশ্বাস নেই, তাঁর কোনটিতেই নেই।

সাগরে নিধিরত্ন যেমন জলের উপর থাকে না, জলের ভিতরে থাকে এবং খুব ডুব দিলে সেসব রত্ন যেমন পাওয়া যায়, তেমনি রামকৃষ্ণলীলা-সাগরে ডুব দাও, নানা নিধি পাবে, আর তাঁকে রত্নাকর বলে জানতে পারবে।

পা। আপনি যে বললেন, সকল অবতার যা করেছেন, রামকৃষ্ণদেব সেসব করে আবার তার চেয়ে বেশি কিছু করেছেন; তাহলে আপনি কি বলেন, রামকৃষ্ণদেব অন্যান্য অবতারের চেয়ে বড়?

ভ। সকল অবতারে সেই এক ভগবান। ভিন্ন ভিন্ন নামরূপমাত্র ও ভিন্ন ভিন্ন লীলামাত্র। যখন যে লীলায় যা কাজ আবশ্যক হয়, তখন এক অবতার হয়ে সেই কাজ করেন। তাঁর প্রত্যেক অবতারে

১৫

সব কাজ করবার শক্তি থাকে, তবে সব কাজের আবশ্যক হয় না।

তুমি তোমাদের রঙ্গালয়ের দৃষ্টান্তে বুঝে লও। তোমাদের 'জনা' অভিনয়ে অনেক চরিত্রের অভিনয় আছে, কিন্তু তুমি কেবল বিদূষকের চরিত্রটিই অভিনয় কর; কিন্তু যদি রাজার, কি শিবের, কি গঙ্গারক্ষকের, কি অর্জুনের চরিত্র অভিনয় করতে হয়, তাহলে কি পার না? পার - তবে আবশ্যক হয় না; তেমনি সেই সর্বশক্তিমান ভগবান যে অবতারে যা দরকার, সেই অবতারে তাই করেন। এই রামকৃষ্ণ-অবতারে সব আদর্শ অবতারের খেলা দেখানো আবশ্যক হওয়ায়, সব দেখিয়েছেন। তার আবার অবতারের মধ্যে ছোট বড় কি আছে?

পা। আপনার কথায় তো বেড়ে মজা দেখছি - যেন কি দেখছি। রামকৃষ্ণদেব ভগবান! আমরা তাঁকে বার তের বৎসর পূর্বে দেখেছি, ছুঁয়েছি, কই তাতে কি হলো?

ভ। তাঁকে দর্শন করে কিছু হয়নি, এমন কথা মনে আনতে নেই। তোমাদের খুব হয়েছে, তবে বুঝতে পারছ না বটে। দুর্লভ জিনিস সহজে পেলে জিনিসের কিম্মত জানা যায় না, মানুষে তা জানতেও পারে না। তোমাদের কি হয়েছে শুনবে? তোমরা ভববন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছ; তার উপর তাঁর কৃপা পেয়েছ, রামকৃষ্ণদেবের মহল্লীলা শুনতে লালায়িত হয়েছ, আবার সকলের সার তাঁর স্বরূপ জানতে ব্যগ্র হয়েছ। মানুষের ভাগ্যে এর চেয়ে আর কি হয়? ঈশ্বরীয় কথা শ্রবণ, ঈশ্বর-দর্শন - মনুষ্যজীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। মানুষ কাম-কাঞ্চনের দাস, কাম-কাঞ্চনের জন্য লালায়িত! তোমরাও বরাবর তাই ছিলে, আজ যে কর্মের ফলে ভগবৎ-পাদপদ্মে অনুরক্ত হয়েছ, সেই কর্মটিই রামকৃষ্ণদর্শন।

পা। আমরা রামকৃষ্ণদেবকে বার তের বৎসর পূর্বে দর্শন করেছি,

১৬

কিন্তু এখন যেমন তাঁর কথা শুনতে, তাঁর শ্রীমূর্তি ফুল দিয়ে সাজাতে মনে হচ্ছে, এমন এত দিন হয়নি কেন?

ভ। এর উত্তর - রামকৃষ্ণদেব বলতেন, একটি বাড়ির কার্নিসে বীজ তোলা ছিল, কালক্রমে অনেক বৎসর পরে বাড়িটি ভূমিসাৎ হলো; তখন ঐ বীজ তাত-বাত পেয়ে আঁকুরে উঠল। তোমাদেরও তাই। এখন সময় হয়েছে। ফল সময়সাপেক্ষ।

পা। আপনার কথা শুনে, আমাদের খুব আশা ভরসা হচ্ছে, আর মন-প্রাণ শীতল হচ্ছে।

ভ। এ আমার কথা নয়; আমি যা বলছি, সব সেই জগৎ-গুরু রামকৃষ্ণদেবের কথা; আমার মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে মাত্র! ছাদে বাঘের মুখ থাকে, বৃষ্টি হলে লোকে বলে বাঘের মুখ দিয়ে জল পড়ছে; কিন্তু সে বাঘের মুখের জল নয়, সে আকাশের জল। আমার নিজের কথা, শক্তি, বুদ্ধি কিছুই নেই - সব তাঁর।

রামকৃষ্ণদেবের একটি অভয়দাতা নাম আছে, সে নামের মহিমায় তোমাদের আশা-ভরসা বাড়ছে। রামকৃষ্ণদেব আনন্দময়, তাঁর লীলাকথায় আনন্দস্রোত বয়, তাই তোমাদের আনন্দ হচ্ছে। তোমরা ভাগ্যবান, তাঁকে প্রত্যক্ষ দর্শন করেছ, তাঁকে স্পর্শ করেছ, যাঁর বাড়া নাই তাঁর মহাপ্রসাদ ধারণ করেছ, তোমাদের তো লীলাকথা শুনে আনন্দ হবেই। তাঁর লীলাকথা শ্রবণ-কীর্তনের এমন গুণ যে, যদি অতি বদ্ধজীবও শুনে, কি কীর্তন করে, সেও আনন্দ-সাগরে ভাসতে থাকবে। সংক্ষেপে তোমায় বলি শুন - জগতে এমন জীব কেউই নেই, যে সরল প্রাণে রামকৃষ্ণনাম করলে পরম আনন্দ না পায়; জগতে এখনো এমন পাপের সৃষ্টি হয়নি যে, একবার সরল প্রাণে রামকৃষ্ণনাম করলে তা তৎক্ষণাৎ ভস্মীভূত না হয়; আর এখনো জগতে এমন ত্রিতাপ-জ্বালার সৃষ্টি হয়নি যে, একবার রামকৃষ্ণনাম করলে তা শীতল না হয়।

১৭

পা। যাঁরা রামকৃষ্ণদেবকে দর্শন করেছেন, কিন্তু চিনতে পারেননি যে, তিনি ভগবান - এমন অবস্থায় সেসব দর্শকের ভগবান-দর্শন হলো কি না?

ভ। তাঁদেরও ভগবান-দর্শন হলো। মনে কর, তুমি কাশ্মীরে শীতকালে রাত্রিতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছ। তুমি বিদেশী লোক, একটি বাসা খুঁজছ, এমন সময় শহরের ভিতরে একটি কোটালের সঙ্গে দেখা হলো, তিনি শশব্যস্তে একটা বাসাবাড়ির ঠিকানা বলে দিলেন। কোটালটি কে জান? তিনি কাশ্মীরের রাজা; কোটালের বেশে দু-একজন আপনার চেনা লোককে আপনার মতো সাজিয়ে সঙ্গে করে নগরভ্রমণ করছেন। এখন জিজ্ঞেস করি বল দেখি, তুমি যাঁর সঙ্গে কথা কইলে, যিনি তোমাকে বাসার ঠিকানা বাতলে দিলেন, তিনি আসলে লোকটি কে? তুমি চিনতে পারলে না বলে কি বলব যে তিনি রাজা নন? তিনি রাজা, কোটালের বেশে মাত্র। তেমনি রামকৃষ্ণদেব অখিলের রাজা, তবে রামকৃষ্ণবেশে এইমাত্র। ইনিও আপনার সঙ্গে পার্ষদদিগকে আপনার মতো মানুষের বেশ পরিয়ে ধরা-শহরে এসেছেন। এবার তুমি বুঝে দেখ যে রামকৃষ্ণদেবের দর্শনে তাঁদের ভগবান-দর্শন হয়েছে কি না?

পা। অতি সুন্দর কথা, বড় আনন্দের কথা। আচ্ছা, না চিনে ঈশ্বরকে দর্শন করলে কি ঈশ্বর-দর্শনের কাজ হয়?

ভ। একটা উনুনের কাছে একজন ঘুমুচ্ছে। রাতের বেলায় ঘুমের ঘোরে যদি তার হাতটা আগুনে পড়ে, তাহলে হাতটা পুড়ে কি না? যদি অজান্তে আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে, তাহলে অজান্তে ঈশ্বরকে দর্শন করলে ঈশ্বর-দর্শনের কাজ হবে না কেন?

পা। আপনার কথা শুনে আমার প্রাণটা কেমন করছে, আমার মনে হচ্ছে, আমি যদি এখুনি রামকৃষ্ণদেবকে চিনতে পারি। আর একবার বলুন তাঁকে চিনবার কি উপায়।

১৮

ভ। আমি তোমার আগ্রহ দেখে বেশ বুঝতে পারছি যে, তোমার উপর রামকৃষ্ণদেবের অপার কৃপা; ভাই, এইমাত্র তোমাকে বললাম যে, ভগবানের অবতারের কোন বিশেষ লক্ষণ নেই, তিনি চিনিয়ে দিলেই তাঁকে চেনা যায়, নচেৎ কার সাধ্য তাঁকে চিনে। রামকৃষ্ণদেবের শ্রীমুখে শুনেছি রাম যখন বনে যান, তখন তাঁকে কেবলমাত্র সাতজন মুনি চিনতে পেরেছিলেন যে, ইনি সেই পূর্ণব্রহ্ম সনাতন, আর অপর সকলে জানতেন, রাম - রাজা দশরথের ছেলে। 'শ্রীকৃষ্ণরহস্য' নামক একখানা প্রাচীন সংস্কৃত নাটক আছে, তাতে দেখা যায় যে, কুরুসভাতে শ্রীকৃষ্ণ ভগবান কিনা, এ সম্বন্ধে অনেক জল্পনা হয়েছিল।

পা। পরমহংসদেব এমন জিনিস, তবে লোকে অনেক বিপরীত কথা বলে কেন? কেউ কেউ বলে তিনি মহাত্মা, কেউ কেউ বলে তিনি একজন সাধু, কেউ বলে সিদ্ধ; আবার কেউ কেউ এমন কথা বলে যে, মুখে বলা যায় না, কানে শুনা যায় না।

ভ। মানুষ আকারে একরকম হয়েও নানা প্রকৃতির। যার যেমন উপলব্ধি, যার যেমন জিনিস ভিতরে আছে, সে সে-রকম কথা বলে। রামকৃষ্ণদেবের একটি গল্প শুন। একজন মহাপুরুষ ভাবে মগ্ন হয়ে বাহ্য-চেতনা হারিয়ে একটি পথের ধারে পড়ে আছেন, এমন সময় একজন সাধু দেখে চিনতে পারলেন যে ইনি মহাপুরুষ। সাধু তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে, তাঁর সেবার জন্য ভাবাবসানের অপেক্ষায় একপাশে বসে রইলেন। তার কিছু সময় পরে একজন মাতাল উপস্থিত, সে টলতে টলতে একবার দাঁড়িয়ে মহাপুরুষকে দেখে বললে - বাঃ, এই যে আমার মতো ভায়ারও ফলার!

ঠাকুরের আর একটি কথা। যে সূতার ব্যবসা করে, সে সূতা দেখলেই কোনটি কোন্ নম্বরের সূতা বলে দিতে পারে। সাধু - সাধু দেখলেই চিনতে পারেন।

১৯

আর একটি উপমা - যে মূলো খেয়েছে, যার পেটের ভিতর মূলো গজ গজ করছে, সে ঢেঁকুর তুললেই খালি মূলোর গন্ধ উঠবে; তেমনি যাদের মনে প্রাণে পেটে কেবল কাম-কাঞ্চন, যারা সংসার-কীট, নেহাত বদ্ধজীব, তাদের মুখে অবিদ্যার ভাব ভিন্ন আর কি বেরুবে? তাদের কথা শুনলে কানে হাত দিতে হয়; যে স্থানে থাকে, সে স্থান অবিলম্বে পরিত্যাগ করতে হয়। ঈশ্বর আর অবিদ্যামায়া (কাম-কাঞ্চন) এ দুটি জিনিস। এ দুটির মধ্যে যার যেটি ইচ্ছা, সে সেটি পায়। নদী যেমন দুকূল বজায় রাখতে পারে না, তেমনি জীব দুটি একসঙ্গে পায় না। হয় আমিরি নাও, নয় ফকিরি নাও; হয় তেতলা নাও, নয় গাছতলা নাও। কাম-কাঞ্চন যাঁরা প্রাণের সাধে নিয়েছেন, তাঁদের ঈশ্বরের পথে কাঁটা। কাম-কাঞ্চনের একটা নেশা আছে, সেই নেশায় তার দুয়ার-ধরা সেবকদিগকে বুঁদ করে রাখে, মাথাটি তুলতে দেয় না। পানা যেমন জল ঢেকে রাখে, মেঘ যেমন চাঁদকে আড়াল করে রাখে, তেমনি মায়া ঈশ্বরকে লুকিয়ে রাখে। ন্যাবা লাগলে যেমন রোগী খালি হলদে রং দেখে, তেমনি মায়া-ন্যাবা ধরলে কাম-কাঞ্চনের বর্ণ বই আর কিছু দেখতে পাওয়া যায় না।

অবিদ্যামায়ার নেশার আর একটা মহিমা বলি শুন, নেশাটায় পড়লে অমনি বুদ্ধিটিকে গুলিয়ে দিয়ে, জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলিকে বলি দিয়ে মানুষকে অমনি ভেড়া করে ফেলে; তাদিগকে জানতে দেয় না যে, তাদের হদ্দ-মুদ্দ দুর্দশা ও সর্বনাশ হয়েছে। আর একটি কথা, পাগলকে বা ভূতে পাওয়া লোককে যদি জিজ্ঞেস করা যায়, হাঁ গো, তুমি কেমন আছ? সে যেমন বলে, বেশ আছি, তেমনি এরাও বলে, বেশ আছি।

এখন যা জিজ্ঞেস করেছিলে তার উত্তর দিলাম। বেশ বুঝে দেখ, কাম-কাঞ্চনের নেশা না কাটলে ঈশ্বরের পথে গমনের,

২০

ঈশ্বরলাভের কোন উপায় নেই। এমন-কি, সিদ্ধপুরুষকে দেখলে তাঁকে শ্রদ্ধা করা দূরে থাক বরং কটুকাটব্যই পেয়ে থাকে। ঘোর বদ্ধজীব যারা, তারাই পরমহংসদেবকে অযথা বলে।

পা। নেশাটা তবে কাটে কিসে?

ভ। রামকৃষ্ণদেব একটা বেশ ঔষধ বাতলে দিয়েছেন। ঔষধটিও আজকাল তাঁর কৃপায় সহজে পাওয়া যায়। ঔষধটি সাধু-সঙ্গ। ঠাকুরের উপমা - যদি কেউ সিদ্ধি কি গাঁজার নেশায় হতচেতন হয়, তাহলে তাকে যেমন চাল-ধোয়ানি জল খাওয়ালে নেশা কাটে, তেমনি যারা অবিদ্যার নেশায় হুঁশ হারিয়েছে, তাদের পক্ষে সাধু-সঙ্গ একেবারে ডি. গুপ্ত - ভারি দাওয়াই।

পা। কাম-কাঞ্চনের নেশা কাটাতে হলে, যাদের মাগ ছেলে চাকরি বা বিষয়াদি আছে, তা কি ত্যাগ করতে হবে?

ভ। তা কেন? রামকৃষ্ণদেব সংসারীকে কাম-কাঞ্চন ছাড়তে বলেননি। তবে কাম-কাঞ্চনের আসক্তিটি ছাড়তে বলেছেন। তিনি বলেছেন, কাম-কাঞ্চনকে অন্তরে ঠাঁই দিও না। কাম-কাঞ্চনের উপর ভেসে বেড়িও। কেমন জান, যেমন জলের উপর যদি নৌকা থাকে, তাহলে নৌকার কোন হানি হয় না, কিন্তু যদি নৌকার ভিতর জল ঢোকে, তা হলেই নৌকার সর্বনাশ। ধর্মপত্নীকে ঈশ্বরলাভের সহায় মনে করো, একটি কি দুটি ছেলে হলেই ভাই-বোনের মতো থেকো, আর উভয়েই সর্বদা ভগবানের সেবা করো। কাঞ্চনকে ডাল-ভাতের যোগাড় মনে করো। ঈশ্বরলাভ করবার পথে সংসার খুব নিরাপদ স্থান। রামকৃষ্ণদেব সংসারকে কেল্লার উপমা দিতেন। যেমন কেল্লার ভিতর থেকে লড়াই করলে বিপক্ষের গোলাগুলি ও অস্ত্রাদি গায়ে লাগে না, ক্ষুধা-তৃষ্ণার সময় পান ভোজন করতে পাওয়া যায়, আবার একদিকে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করাও চলে, তেমনি সংসারে ভাত-ডালের সঞ্চয় থাকায় সময়মত খেতে পাওয়া যায়,

২১

ধর্মপত্নীর সহবাসে কোন দোষ হয় না; আত্মীয় বন্ধু পরিবারবর্গ আছে, পীড়ার সময় সেবা করে। ফাঁকে বেরিয়ে গেলে, এসব সুবিধা থাকে না, কিন্তু প্রয়োজনগুলি সব থাকে।

তবে এর ভিতর একটি কথা আছে - আগে সংসারকে চিনতে হয়, তারপর তায় ঢুকতে হয়, নচেৎ ভারি মুশকিল। কাঁচা মানুষের সংসারে প্রবেশ করা আর হাতে তেল না মেখে কাঁঠাল ভাঙা একই কথা। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে যেমন হাতে আঠা লাগে না, তেমনি মনে জ্ঞান ভক্তি মাখিয়ে সংসারে প্রবেশ করলে কাম-কাঞ্চনের আসক্তিতে লটপট করাতে পারে না। আগে জ্ঞান ভক্তি অর্জন, পশ্চাৎ সংসারে প্রবেশ।

ঠাকুরের উপদেশ - গায়ে হলুদ মাখা থাকলে যেমন জলে কুমিরের ভয় থাকে না, তেমনি মনে জ্ঞান ভক্তি থাকলে সংসারে কাম-কাঞ্চন কিছু করতে পারে না।

আর একটি উপমা - লুকোচুরি খেলায় যে বুড়িকে ছোঁয়, তার যেমন আর চোর হবার ভয় থাকে না, তেমনি ঈশ্বর লাভ করে সংসারে থাকলে আর চোর হতে হয় না।

আর একটি উপমা - খুঁটি ধরে বনবনিয়ে ঘুরলে যেমন পড়বার কোন আশঙ্কা থাকে না, তেমনি ভগবানকে ধরে সংসারে যদি কেউ থাকে, তার আর পতনের ভয় থাকে না।

এ সম্বন্ধে ঠাকুরের আর একটা কথা - একজন পাড়াগেঁয়ে লোক, সঙ্গে একটি ব্যাগ আর একটি ছাতা। ব্যাগটিতে কাপড়-চোপড় ও পাথেয় আছে; এখানে কলকাতা শহর দেখতে এসেছে; এ অতি তাজ্জব শহর; সে পাড়াগেঁয়ে নূতন লোক, এখানে যা দেখে, তাই তার পক্ষে আশ্চর্যের জিনিস, হাঁ করে এটি উটি দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তখন কোথায় যায়, কোথায় থাকে, চিন্তা করতে করতে একটা দেউড়িতে বসে পড়ল ও কিছুক্ষণের মধ্যেই

২২

ভাবনায় ও পথশ্রমে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল। একজন জোচ্চোর দেখলে, লোকটা ভারি আহাম্মক - হেলায় ব্যাগটি ও ছাতাটি হাতিয়ে সরে গেল। লোকটা ঘুম থেকে উঠে দেখলে - সর্বনাশ! ঠিক এই রকম যারা সংসার-শহরে এসেছে, তারা যদি আগে আপনার বাসা-ঘর ঠিক না করে ঘুরে বেড়ায়, তাদের এমনি দশা ঘটে।

ঠাকুরের আর একটি বড় সুন্দর কথা - মাঠে বর্ষাকালে কৃষকেরা ঘুনি রাখে। ঘুনির ভিতর জলের চিকচিকানি খেলা দেখে পুঁটিমাছগুলো তার ভিতর ঢুকে, কিন্তু আর বেরুতে পারে না; তেমনি সংসারে কাম-কাঞ্চনের চিকচিকানিতে মুগ্ধ হয়ে, বেরুবার পথ না জেনে যারা সংসার-ঘুনিতে ঢোকে, তাদের পুঁটিমাছের মতো দশা হয়।

সংসারে খুব সাবধান হয়ে চলতে হয়। কাম-কাঞ্চন নিয়ে খেলা, আর সাপ নিয়ে খেলা একই কথা। গুরুদেবের কাছে মহামন্ত্র ও মহৌষধি না শিখে, কাম-কাঞ্চনের সঙ্গে খেলা করলে, প্রাণরক্ষার কোন আশা নেই।

পা। গুরু কি এইসব জানিয়ে দেন? কই আমাদের গুরু তো একটি মন্ত্র ছাড়া আর কিছুই বলে দেননি! তবে কি মশায়, রকমারি গুরু আছেন?

ভ। তুমি যা বললে, তা বুঝেছি। তুমি যে গুরু ও শিষ্যের কথা বললে, তা কেমন জান? যেমন অন্ধের হাত ধরে অন্ধের গমন; পরিণামে উভয়েরই পতন অবশ্যম্ভাবী। তবে যদি শিষ্য ঈশ্বরানুরাগী হয়, তাহলে অনুরাগের বলে সে সেই গুরুর ভিতরেই আসল গুরু বের করে নিতে পারে। এখানকার মতে, গুরু একটি আলাদা আর আসল গুরু একটি আলাদা। আসল গুরুটি কে জান? - ইষ্ট-মূর্তি। মনে কর, পাখি একটি ডিম পাড়লে। কিছুকাল ঐ ডিমে তা দিতে দিতে তার ভিতর থেকে একটি ছানা বেরুল। এখানেও অবিকল তাই। গুরু কানে মন্ত্র দিলেন; সেই মন্ত্রের

২৩

মধ্যে একজন ইষ্ট আছেন। এখন সেই মন্ত্রে সাধন, ভজন, ধ্যান, জপ ইত্যাদি তা দিতে দিতে তার ভিতর থেকে শাবকরূপে ইষ্ট-মূর্তি বেরিয়ে পড়েন। যখন ইষ্ট বেরুলেন, তখন আর গুরু নেই। ছানাটি বেরুলে, ডিমটি আর থাকে না।

পা। যদি গুরু ও ইষ্ট আলাদা, তবে আপনারা পরমহংসদেবকে কি মনে করেন?

ভ। এখানে একাধারেই গুরু-ইষ্ট। যতদিন ধরা না দিয়ে খেলা করেন, তত দিন গুরু; যখন ধরা দেন, তখন ইষ্ট। ওখানে যেমন ইষ্ট পেলে আর গুরুরূপ থাকে না, এখানে সেরূপ নয়, ইষ্ট পেলেও রামকৃষ্ণরূপ থাকে।

পা। গুরু কাকে বলে?

ভ। গুরু এক, গুরু সেই ভগবান। ভগবান ভিন্ন গুরুপদ-বাচ্য আর কেউ নয়। তবে এই গুরু লাভ করবার অন্য পথে যে-সকল উপদেষ্টা পাওয়া যায়, তাদের উপগুরু বলে। এই উপগুরুর মধ্যে মানুষই যে থাকেন, এমন কথা নয়, পশুও থাকতে পারে, পাখিও থাকতে পারে, বৃক্ষ-লতাও থাকতে পারে, আবার দেব-দেবীও থাকতে পারেন। পথে এদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে, কিন্তু গুরু যখন পাওয়া যায়, তখন আর বড় সম্পর্ক থাকে না। তখন গুরু আর শিষ্য। উপগুরুতে কত দিন সম্পর্ক থাকে আর কখন বড় থাকে না, তার একটা উপমা দিয়ে তোমাকে বলি শুন। একটি বরের যখন সম্বন্ধ হয়, তখন যে গ্রামে বিয়ে হবে, হয়তো সেই গ্রামের একটি অন্য কোন জাতের মেয়ে কি পুরুষ প্রথমে কথা আরম্ভ করে, তাকে দেখে বর তখন এই ভেবে মনে মনে আদর করে যে, যে গাঁয়ে আমার বিয়ে হবে, সেই গাঁয়ে এর ঘর। তারপর দেখা-শুনার জন্য প্রতিবাসীরা আসে। বর তখন প্রথম ঘটক বা ঘটকীকে ছেড়ে দিয়ে প্রতিবাসীদিগকে এইভাবে মনে মনে আদর করে যে, যাদের

২৪

ঘরে বিয়ে হবে, এরা তাদের প্রতিবাসী। তার পর যখন পাকা দেখবার আবশ্যক হয়, তখন হয় কনের বাপ, কি খুড়ো, কি মামা, কি ভাই, এদের যত লোকের আসার প্রয়োজন হয়। তখন বর প্রতিবাসীকে ছেড়ে কনের বাপ, কি মামা, কি ভাই, এদিগে চিনে। বিয়ে হয়ে গেলে সব ছেড়ে যায়, থাকে বর আর কনে। এখানেও ঠিক সেই রকম, গুরু পেলে আর বড় কেউ থাকে না, তখন কেবল গুরু আর চেলা।

রামকৃষ্ণদেব বলেন, গুরু ঘটক। নায়ক-নায়িকার সম্মিলন-কাজে যেমন একজন ঘটকের আবশ্যক, ভগবানে ও জীবে মিলনের জন্য তেমনি গুরুর দরকার। এই গুরু রামকৃষ্ণদেব। তোমরা শুনেছ তিনি কৃপা করে একবার ছুঁয়ে দিলেই, লোক আপনার গুরু তাঁর ভিতরে দেখতে পেতেন। ভগবান না হলে কার সাধ্য ভগবান দিতে পারে? তিনি আপনি ছুঁয়ে শক্তি দিয়ে আপনাকে দেখিয়ে দিতেন।

রামকৃষ্ণদেব কেমন গুরু তোমাকে সংক্ষেপে বলি শুন:

রামকৃষ্ণদেবকে কেউ একবার ধরে তারপর যদি ছেড়ে দেয়, তিনি আর ছাড়েন না; সে ভুললে তিনি আর ভুলেন না, সে টললে তিনি আর টলেন না।

রামকৃষ্ণদেবকে বন্ধু বলে একবার বাঁধন দিয়ে কেউ যদি খোলে, তিনি আর খোলেন না। রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে একবার যার ছোঁয়াছুঁই হয়ে গেছে, তিনি যে আবার কাম-কাঞ্চনে আসক্ত হবেন, সে পথে একেবারে কাঁটা।

রামকৃষ্ণদেবের ভাবাবেশের আশাবাণী - আমি যাকে ধরব, তাকে নিজের বরণ ধরিয়ে ছাড়ব। কাঁচপোকা আরসোলাকে ধরলে আরসোলার কাঁচপোকার বর্ণ হয়।

তাঁর আর একটি ভাবাবেশের কথা - আমি জাত-সাপ, যাকে একবার ছোবলাব, তাকে তিন ডাকের বেশি আর ডাকতে হবে না।

২৫

রামকৃষ্ণদেব যার গুরু হন, তার আর কোন কর্ম নেই। কেবল বগল বাজিয়ে দুহাত তুলে প্রাণ ছেড়ে ফুর্তি করাই তার কাজ। তার জন্য তরী ঘাটে বাঁধা। সদা-সর্বদা চোখের উপর সে ঘাটও দেখতে পাচ্ছে, তরীও দেখতে পাচ্ছে, আর কাণ্ডারীকেও দেখতে পাচ্ছে। সে আপনার মনে, মনের মতন খেলে বেড়ায়। মনে জানে যখন মন যাবে, তখন পার হয়ে চলে যাব। সে সংসারে খেলতে ভয় করে না। আগে চোখ মুদে খেলে অনেকবার পড়েছে, এখন চোখ চেয়ে খেলতে শিখেছে। আগে সংসার ধোঁকার টাঁটি ছিল, এখন সংসার তার মজার কুঠী হয়েছে।

তোমরাও তো এখন কিছু বুঝতে পেরেছ। চোখ মেলে দেখ রামকৃষ্ণদেব কি! তিনি শুধু তোমার আমার গুরু নন, তিনি জগদ্গুরু। রামকৃষ্ণদেব চাঁদা মামা - সকলেরই সমান।

পা। এ্যাঁ, রামকৃষ্ণদেব সাক্ষাৎ ঈশ্বর! ঈশ্বর-দর্শনের ফল কি?

ভ। পরমহংসদেবের মহা বিশ্বাসী ভক্ত তোমাদের গিরিশবাবু, যাঁর মতো কবি ও নাট্যকার এখন আর দেখতে পাই না, একখানি গ্রন্থে লিখেছেন, 'কৃষ্ণ-দর্শনের ফল - কৃষ্ণ-দর্শন'। আমিও তাই বুঝি।

পা। এটি বড় আশা-ভরসার কথা। আমরা কি আবার ভগবানকে রামকৃষ্ণরূপে দেখতে পাব?

ভ। নিশ্চয় পাবে। দেখবার জন্য ব্যাকুল হলেই দেখতে পাবে। তাঁর বিগ্রহরূপটিও দেখতে পাবে, তা ছাড়া আরও রূপ আছে, তাও দেখতে পাবে। তিনি রূপের সাগর, তাঁর অনেক রূপ আছে।

পা। আমরা রামকৃষ্ণদেবের মহাসমাধির কথা শুনেছি। তাঁর শ্রীঅস্থি কলসী-মধ্যে যে দিন কাঁকুড়গাছিতে রামবাবুর বাগানে সমাধি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন আমরাও তো ছিলাম। সে দেহ তো নষ্ট হয়ে গেছে, আবার কি করে দেখতে পাব?

ভ। ভাই, তুমি রামকৃষ্ণদেবকে মনুষ্য জ্ঞান করে কথা বলছ।

২৬

তোমাকে বারবার বলেছি যে, তিনি ঈশ্বর। রামকৃষ্ণরূপ তাঁর বিগ্রহরূপ। তাঁর দেহ পাঞ্চভৌতিক হলেও পাঞ্চভৌতিক নয়। রামকৃষ্ণদেবের দেহ চিন্ময় দেহ। দেহখানি চৈতন্যের জমাটবাঁধা। দেহের অণু-পরমাণু চৈতন্যময়, তা আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। তাঁর নরলীলার অবসান হয়েছে বটে, কিন্তু দেহের অবসান হয়নি। বিভুবিলাসের দেহ কখনো নষ্ট হবার নয়। ভগবান ভক্তবাঞ্ছা-কল্পতরু, ভক্তদের বাসনা পূর্ণ করবার জন্য বিগ্রহরূপ ধরেন আর সেই বিগ্রহরূপ তিনি কখনো নষ্ট করেন না ও সেরূপ করবার তাঁর অধিকারও নেই। ভগবানের বিগ্রহরূপ ভগবানের নয়, সেটি - ভক্তদের।

তোমার সন্দেহ-ভঞ্জনের জন্য পরমহংসদেবের একটি ভক্তের কথা বলি, শুন। ভক্তটির নাম শ্রীদুর্গাচরণ নাগ। ইনি ঠাকুরের লীলাবসানে অত্যন্ত অধৈর্য হয়ে পড়েন। অন্ন-জল ত্যাগ। তিন-চারি দিন উপবাসের পর নরেন্দ্রজী খবর পান। নরেন্দ্রজীর অতি কোমল হৃদয়, দুর্গাচরণের বাসায় গিয়ে দেখেন যে, তিনি মৃতপ্রায় পড়ে আছেন। নরেন্দ্রজী তাঁকে খাওয়াবার জন্য অনেক চেষ্টা পান, কিন্তু কৃতকার্য হতে পারলেন না। তখন তিনি বললেন, আমাকে কিছু খেতে দাও। দুর্গাচরণ অমনি দোকান থেকে একঠোঙা খাবার এনে দিলেন। নরেন্দ্রজী যে কচুরিটি, কি গজাটি এক কামড় খেয়ে তাঁর হাতে দেন, তিনি সেইটি খান। নরেন্দ্রজীর উদর পূর্ণ ছিল, কত খাবেন! অবশিষ্ট খাবারগুলি দুর্গাচরণকে খাবার জন্য তাঁর হাতে দিলেন। তিনি 'হায় রে পোড়া কপাল' এ কথাটি বলতে বলতে ঠোঙার খাবারগুলি দ্রুতপদে গঙ্গার জলে ফেলে দিলেন। পরদিন প্রতিবাসীরা অনেক জিদ ও ধরাবাঁধা করে তাঁকে ভাত রান্না করালেন, ভাত যখন ফুটে এল, তখন দুর্গাচরণ একটা চেলা-কাঠ দিয়ে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ি ভেঙে দিলেন, আর এই বলে কাঁদতে লাগলেন, "হায় রে, আমার তেমন ঠাকুর চলে গেলেন, আর আমি ভাত খাব!" ঠাকুর

২৭

দুর্গাচরণকে নাছোড়বান্দা দেখে তাঁকে দেখা দিলেন; তারপর তিনি রেঁধে ভাত খান।

পা। আহা! ঠাকুরের কথা যেমন মিষ্টি, ঠাকুরের ভক্তদের কথাও তেমনি মিষ্টি। রামকৃষ্ণদেবের ভক্তদের কথা আরও কিছু বলুন না মশায়!

ভ। তোমার জিজ্ঞাসা শুনে আমারও খুব আনন্দ হলো। রামকৃষ্ণদেবের এমন একটি কৃপা তোমার ভিতরে আছে যে, তাঁর লীলা-কথা তোমাকে বলতে বলতে আমার হৃদয়েও ফোয়ারা উঠছে; যা জানি না, তাও ঠাকুর জানিয়ে দিচ্ছেন। তোমার মতো লীলাতত্ত্ব-পিপাসুর সঙ্গ পেয়ে আমিও ধন্য হলাম। রামকৃষ্ণদেবের ভক্তদের কথা অতি মধুর, আবার জীবশিক্ষার জন্য তাঁদের সঙ্গে ঠাকুর যে-সকল খেলা করেছেন, সেগুলি আরও মধুর। শুনলে পাষাণে জল ঝরে, মরা গাছে মঞ্জরী উঠে, অতি বদ্ধজীবেরও চৈতন্য হয়, ভক্তি হয়, তাদের ভবসাগর পার হবার সম্বল হয়। 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপুঁথি'-তে ও তাঁর সম্বন্ধীয় বিবিধ গ্রন্থাদিতে এসব কথা আছে। সে-সমস্ত গ্রন্থ দেখলে সকল খবর জানতে পারবে।

পা। আচ্ছা মশায়, তবে এখানের কথাই বলুন। আপনি যে বললেন, রামকৃষ্ণদেবের রামকৃষ্ণরূপ ছাড়া আরও রূপ আছে, সে কি রকম? তিনি কিরূপেই বা রূপের সাগর হলেন?

ভ। রামকৃষ্ণরূপটি আমাদের প্রিয় রূপ। এইটি তাঁর বিগ্রহরূপ, আর একটি বিরাট রূপ আছে। তাঁর নিরাকার ভাবও আছে। আবার তিনি বলেছেন, সাকার নিরাকার ছাড়া ভগবানের আরও একটি অবস্থা আছে। ভক্তেরা তাঁর বিগ্রহরূপ ভিন্ন অন্য রূপ দেখতে চান না, কিন্তু তিনি কিছু কিছু না দেখিয়ে ছাড়েন না।

পা। বিগ্রহরূপ রামকৃষ্ণরূপ বুঝলাম, আর আমরা ঐটিই দেখেছি - বিরাটরূপ আবার কেমন?

২৮

ভ। এই জীব-জগৎ নিয়ে যে রূপটি সেটিই রামকৃষ্ণদেবের বিরাট রূপ। সেই বিগ্রহরূপধারী জগদ্গুরু রামকৃষ্ণদেব বিরাটে বহু হয়েছেন। স্থাবর, জঙ্গম, বৃক্ষ, লতা, গিরি, নদী, অনিল, অনল আর যাবতীয় প্রাণী যা দেখছ, যা শুনছ সেসব তিনি হয়েছেন। তিনি সকলের ভিতরে বাহিরে রয়েছেন। তিনি ভিন্ন আর কেউই নেই, আর কিছুই নেই। যা কিছু আছে, তা সেই তিনি।

পা। অদ্ভুত কথা - আপনি কি শাস্ত্রের কথা বলছেন আর ঈশ্বরের জায়গায় রামকৃষ্ণ নামটি বসিয়ে দিয়ে তাঁর মহিমা অযথাভাবে বলছেন? না - যা দেখছেন তাই বলছেন?

ভ। রামকৃষ্ণদেবের অপার মহিমা - রামকৃষ্ণদেব ঈশ্বর, তিনি সর্বেশ্বর, রাজরাজেশ্বর। তুমি শাস্ত্রের কথা বলে মনে করছ! আমি শাস্ত্র কাকে বলে, তার নাম-গন্ধও জানি না - এমন কি রামায়ণ, মহাভারত, যা দোকানী-পসারী জানে ও পাঠ করে, আমি এই বয়স নাগাত তাও জানি না এবং কখনো পাঠও করিনি। আমার ত্রিশ বৎসর যখন বয়স, তখন রামকৃষ্ণদেবের দর্শন লাভ করি। তখন পর্যন্ত আমি জানতাম না যে, কুরুপাণ্ডব রামায়ণে আছে কি মহাভারতে আছে। একদিন রামকৃষ্ণদেব আমাকে বললেন - হ্যাঁগা, তুমি কি ব্রাহ্ম? আমি সে-কথার কিছু জবাব দিতে পারলাম না। তখন পর্যন্ত আমি জানি না যে ব্রাহ্ম কাকে বলে, শাক্ত কাকে বলে, শৈব কাকে বলে, ভগবান কাকে বলে - আমি তাও জানি না। তিনি আছেন কি-না - তাও জানি না, আর সে-বিষয়ে কখনো ভাবিও না। তবে পরমহংসদেবকে দর্শন করবার এক বৎসর পূর্বে পাড়াগেঁয়ে গুরু কানে কৃষ্ণমন্ত্র দিয়েছেন - যখন মন্ত্র দিলেন, তখন গুরুকে বললাম, এই যে বারবার মন্ত্র বললাম কই কৃষ্ণকে তো দেখতে পাচ্ছি না। তিনি বললেন - সে কি তুমি পারবে - পুরশ্চরণ করতে হয় - আর কত কি করতে হয়! তুমি গঙ্গাতীরে থাক, স্নানের পর বারো বার মাত্র

২৯

জপ করো। আমি কথা শুনে কেমন হয়ে গেলুম। সেই দিন থেকে কিসে কৃষ্ণকে দেখতে পাই, কৃষ্ণের সঙ্গে খেলা করতে পাই, কৃষ্ণের সঙ্গে একসঙ্গে গুড় রুটি খেতে পাই, এর জন্য প্রাণে ব্যাকুলতা উঠল। কৃষ্ণ যে ভগবান - এ মনে করে নয়, কৃষ্ণ যে পারের কাণ্ডারী - এ মনে করে নয়; তবে কৃষ্ণকে কৃষ্ণ মনে করে, কৃষ্ণ বেশ দেখতে, এই মনে করে। তাঁর হাত থেকে বাঁশীটি কেড়ে নিয়ে তাঁকে কাঁদাব, এই মনে করে; তাঁর ননীর দেহটি দেখব, এই মনে করে - তাঁকে কোলে করে বেড়াব এই মনে করে; ফুল দিয়ে তাঁকে সাজাব, এই মনে করে। গুড় রুটি আমার প্রিয় জিনিস, তাই তৈয়ার করে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে খাব, এই মনে করে - আর কত কি, তোমায় কত বলব! তখন আমাকে গয়লা বলে মনে ভাবতুম - কেউ যদি বলত, আমি বৃন্দাবন থেকে এলাম - আমি ব্রজবাসী - আমি অমনি তাকে বলতাম, কানাই কেমন আছে? কখনো কখনো আমি ব্রজবাসীর মতো আপনার মনে মনে হিন্দী ও বাংলা মিশিয়ে কথা কইতাম। তখন কানাইয়ের গান বাঁধতাম, আবার ব্রজবুলিতে গান বাঁধতাম। এখন আমি রামকৃষ্ণদেবের কাছে এসে পড়েছি - রামকৃষ্ণদেবের কাছে আসাতে এই বাই বেশি চেগে উঠল। রামকৃষ্ণদেবকে তিন দিন দর্শন করেই আমি পাকা বুঝলাম যে, যদি কেউ কৃষ্ণ দেখাতে পারেন, তা হলে ইনিই পারেন, আর কেউ পারে না। এ-সময় আমি মোটেই জানি না যে, যেই কৃষ্ণ - সেই রামকৃষ্ণদেব। এখন কৃষ্ণের সম্বন্ধে কেমন জ্ঞান জান? - কৃষ্ণ যে মধুর রসের রসিক - তা জানি না; কৃষ্ণ যে পাণ্ডবদের রথের সারথি - তা জানি না; কৃষ্ণ যে কংসবধ করেছেন - তা জানি না, কৃষ্ণ যে প্রভাসযজ্ঞের কর্তা - তা জানি না; কৃষ্ণ যে দ্বারকা-লীলা করেছেন - তা জানি না; জানি - কানাই যশোদার নীলমণি, জানি - কানাই রাখালদের সঙ্গী, বাঁশী বাজায়, ননী চুরি করে খায়, গোচারণে যায়। গোকুলে সবাই তাঁকে প্রাণের

৩০

চেয়েও ভালবাসে, রাই আরও ভালবাসে, সে বড় সুন্দর - আমি এ-সকল জানি। একটা গান বলি শুন, তাহলেই ভাবটা বুঝতে পারবে।

যাওয়ে বৃন্দাবনকি চাঁদ, যাওয়ে গোঠবিহারী।
যাওয়ে প্যারী-মোহনীয়া, যাওয়ে বনওয়ারী।
অলকা-তিলকা-শোভিত ভাল, শোভয়ে গলে বনমাল,
জড়িত বাস তড়িত জাল, গোপীগণ-মনোহারী।
মোহনীয়া চূড়া পাখড়ি শিরে, হেলত দুলত পবনভরে,
আঁখি না পালটি রহতুঁ দূরে, নিরখে গোপনারী।
চরণে নূপুর রুনুঝুনু বাজে, হাসত নাচত রাখালমাঝে,
চন্দ্রমা যেসা তারকামাঝে, ঝলকে কিরণ ডারি।
আগে আগে সব চলত ধেনু, চলত পিছুই বাজাই বেণু,
কব্ হি হাম পাওয়ে কানু, মোহন মুরলীধারী।

আমার শাস্ত্রজ্ঞানের কথা বলতে বলতে কোথায় এসে পড়েছি।

পা। এটা ভারি রগড়ের কথা - বলুন, এতে রামকৃষ্ণদেবের জ্বলন্ত মহিমা দেখতে পাচ্ছি।

ভ। আমি পরমহংসদেবকে একদিনও কোন কথা বলিনি বা কিছু জিজ্ঞেসও করিনি, তবে এইটি জানতাম যে, তিনি যার বুকে হাত দেন, সে তখনি বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়, আর ঐ অবস্থায় সে কৃষ্ণ দেখতে পায়। আমি ঐ আশায় তাঁর কাছে যেতে লাগলাম - শুধু যে ঐ আশায় তাও নয়, তাঁকে দেখলে কেমন কেমন হতুম, তাই যেতুম, আর মনে মনে ভাবতুম, কবে কৃপা করে আমার বুকে হাত দেবেন। কত দিন গেল, তিনি আর বুকে হাত দেন না। আমি আশা করে যাই আর নিরাশ হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসি। জীবনে মোটে দুটি কথা তাঁকে বলেছিলুম। একবার একদিন

৩১

তাঁকে নির্জনে পেয়ে বলেছিলুম, ঠাকুর, আমি বড় কানা। তাতে তিনি জবাব দিলেন, ঈশ্বর আছেন। আর একদিন তাঁকে বলেছিলুম - ঠাকুর, আপনি আমার ছোঁয়া কুলফী খেলেন না - আমি বড় অপরাধী। তাতে তিনি মুচকি হেসে বললেন, তুমি যদি দুপুরবেলায় কুলফী আনতে, তা হলে খেতুম; ঠাণ্ডা জিনিস রেতের বেলা খেলে অসুখ হবে, তাই খাইনি। আমার সঙ্গে ঠাকুর যে রকম ব্যবহার করতেন, এমন যদি অন্য কোন লোকের সঙ্গে হতো, তাহলে সে প্রাণ গেলেও আর তাঁর কাছে যেত না। কত লোকে তাঁর পায়ে হাত বুলাচ্ছে আর আমি হাত বাড়ালেই অমনি, হয়েছে হয়েছে বলে পা গুটিয়ে নিতেন। কখনো কখনো পদরজ নিতে গেলে পেছিয়ে চলে যেতেন আর বলতেন, 'হয়েছে, হয়েছে'। তিনি যে এত তত্ত্ব-কথা বলতেন, আমি তার কিছুই বুঝতে পারতাম না, একধারে চুপ করে বসে থাকতাম, আর তাঁকে খালি দেখতাম। আমার বাপকে আমি যেমন ভয় করতাম ঠাকুরকে তেমনি ভয় করতাম। আমার বাপের মুখের আদল ঠাকুরের মুখে দেখতে পেতুম ও এখনও পাই। তোমাকে কত বলব, অনেক কথা। আমার শাস্ত্র - রামকৃষ্ণদেব; আমার জ্ঞান - রামকৃষ্ণদেব। শাস্ত্র দেখার মধ্যে রামকৃষ্ণদেবকে দেখা। আমি যা বলছি - যা তিনি দেখাচ্ছেন তাই বলছি। আমি কারও জায়গায় রামকৃষ্ণদেবকে বসাইনি। আমি রামকৃষ্ণদেবের জায়গায় রামকৃষ্ণদেবকেই বসাচ্ছি। আমি যা দেখছি, তাই বলছি।

পা। আপনি রামকৃষ্ণদেবকে সকলের ভিতর দেখছেন - অদ্ভুত কথা! তিনিই যদি প্রত্যেক বস্তু এবং প্রত্যেক জীব হয়েছেন, তাহলে সেই প্রত্যেক বস্তু বা জীবের ভিতর রামকৃষ্ণদেব কেমন ভাবে আছেন - অংশ কি পূর্ণ?

ভ। বড় অক্ষর না পড়তে শিখলে যেমন ছোট অক্ষর পড়া

৩২

যায় না, তেমনি আগে বিগ্রহরূপ না বুঝতে পারলে বিরাটরূপ বুঝা যায় না। আমি যেমন দেখছি বলি শুন:

অগণ্য রকমের ছোট বড় পাত্র যদি সাগরের জলে ডুবিয়ে রাখা যায় তাহলে প্রত্যেক পাত্রের ভিতরে সাগর যেমন ভাবে থাকে, তেমনি রামকৃষ্ণদেবকে আমি প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে দেখছি। এতে পূর্ণ কি অংশ বুঝে নাও। তবে এই যে ছোট বড় পাত্র দেখছ, কোনটায় কম জল ধরে, কোনটায় বেশি জল ধরে, সে শক্তির খেলা মাত্র।

পা। যদি প্রত্যেক ঘটে অর্থাৎ জীবে সেই সাগরের জল, তবে জীবের মধ্যে ভাল, মন্দ, সৎ, অসৎ ইত্যাদি এত রকমারি কেন?

ভ। সে গুণের জন্য। রামকৃষ্ণদেবের কথা - জল মাত্রই নারায়ণ। তবে এই জল নানা রকমের। কোন জলে খালি হাত-পা ধোওয়া চলে, কোন জলে স্নান করা চলে, কোন জল এমন পবিত্র যে তার বিন্দু-পানে কি স্পর্শে জন্ম-জন্মান্তরের পাপ যায় - আবার এমন জল আছে, যাকে ছোঁয়াও যায় না। এই রকম, রাম সব ঘটে রয়েছেন; কোথাও সাধু রাম, কোথাও লম্পট রাম, কোথাও চোর রাম। কোন রামকে নিয়ে আদর করতে হয়, কোন রামকে দূরে রেখে চলতে হয়।

রামকৃষ্ণদেবের অপর উপমা - সেই শ্যামা কোথাও খাঁড়া ধরে শ্রীমন্দিরে; কোথাও বৌ হয়ে কোণে ঘোমটা দিয়ে বসে, আর কোথাও বারাণ্ডায় হুঁকো হাতে করে রয়েছেন।

"সর্বঘটে বিরাজ করে, ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।"

যত দিন না রামকৃষ্ণদেবের কৃপা হয়, ততদিন এই যে শক্তির খেলা, এসব কিছুই বুঝা যায় না।

পা। ভগবান যখন সকল হয়েছেন আর তিনি চৈতন্যস্বরূপ, তখন পাহাড় পাষাণ প্রভৃতি জড়ের মধ্যে চৈতন্যের খেলা কই?

৩৩

জীবের দেহখানি জড় বটে, কিন্তু ক্রিয়ায় তার মধ্যে চৈতন্যের খেলা দেখতে পাওয়া যায়।

ভ। দুধকে দই, ক্ষীর, ননী, ঘি প্রভৃতি যে-কোন অবস্থায় পরিণত কর না কেন, সকলের মধ্যেই যেমন সেই দুধ বা প্রত্যেকটিই যেমন সেই দুধের অন্যবিধ অবস্থা, তেমনি এক মূল চৈতন্যস্বরূপ ভগবান থেকে যা কিছু হয়েছে, সে-সকলের মধ্যেই তিনি বা প্রত্যেকটি সেই চৈতন্যের অন্যবিধ অবস্থা। তিনিই আধার, তিনিই আধেয়। স্থূলাবস্থায় শরীরের উপাদান হয়ে দেহ হয়েছেন, আর সূক্ষ্মভাবে দেহী বা আত্মা হয়েছেন। এ দিকে যেমন সৃষ্টিতে চৈতন্যের অতি সূক্ষ্মাবস্থা মহাকাশ, মহাকাশের স্থূল - আকাশ, আকাশের স্থূল - তেজ, তেজের স্থূল - মরুৎ, মরুতের স্থূল - জল ও জলের স্থূল - ক্ষিতি; তেমনি জীবের শরীর সম্বন্ধে পরমাত্মা সূক্ষ্মাবস্থা, তার স্থূল জীবাত্মা, জীবাত্মার স্থূল - মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহঙ্কার, তার স্থূল পাঞ্চভৌতিক দেহ। মায়ার অদ্ভুত খেলা।

পা। এই বললেন ভগবানের খেলা, আবার মায়ার খেলা বলছেন? মায়া শুনেছি ভুল, অনিত্য, ঐন্দ্রজালিক মাত্র।

ভ। মন আদির অতীত অতি সূক্ষ্মতম চৈতন্যস্বরূপ ভগবান যে শক্তিতে এত স্থূল হয়ে এই জীব-জগৎরূপে পরিণত হন, সেই শক্তির নাম মায়া। ভগবান যেমন সত্য ও নিত্য, তাঁর মায়াও তেমনি সত্য ও নিত্য। সত্য, নিত্য হতে যা জন্মে, তা কি কখনো অসত্য ও অনিত্য হয়? এই মায়াশক্তিই লীলাশক্তি। এই শক্তির বলে তিনি লীলা করেন। মায়াশক্তি ঈশ্বরাধীন হয়েও ঈশ্বরের চেয়ে মায়ার মহিমা বেশি। মায়াশক্তির খেলা না থাকলে ঈশ্বরের সত্তা, ঈশ্বর ভিন্ন আর কারোরই উপলব্ধির উপায় নেই। লীলাশক্তির খেলা ব্যতীত সৃষ্টিই নেই অর্থাৎ এই জীব-জগৎ নেই। জীব না থাকলে ঈশ্বর থেকেও নেই। যেমন জন্মান্ধের পক্ষে পূর্ণিমার আলো, তেমনি

৩৪

জীবের অসত্তাতে ঈশ্বরের সত্তা থেকেও নেই। মায়াশক্তি সৃষ্টি করে জীবের জননী হয়ে তিনি জীবকে আপনাকে দেখিয়ে দিয়ে পরে ঈশ্বরকে দেখিয়ে দেন। যেমন দর্পণ-সহায়ে প্রতিচ্ছায়া দেখা যায়, সেইরূপ জীব মায়াতে সৃষ্ট হয়ে সেই মায়ার সাহায্যেই ঈশ্বর-দর্শন করে। মায়া পথ ছেড়ে না দিলে জীবের ঈশ্বর-দর্শন হয় না।

মায়াশক্তি ইচ্ছাময়ী, লীলাময়ী, এক হয়ে আবার দুভাবে খেলা করেন। এক বিদ্যাশক্তি আর একটি অবিদ্যাশক্তি। এক শক্তির মধ্যে দুরকম ভাব সে কেমন জান? রামকৃষ্ণদেবের এ সম্বন্ধে উপমা - বিড়ালের একই দাঁত, সেই দাঁতে আপনার ছেলেকে ধরে যখন নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়, তখন ছেলের ঘাড়ে মোটেই দাঁত লাগে না, কিন্তু সেই দাঁতে যখন ইঁদুর ধরে, তখন ইঁদুরের আর দুর্দশার সীমা থাকে না। সেই রকম যখন মায়া বিদ্যাশক্তির দ্বারা জীবকে ধরেন, তখন জীবকে ঈশ্বরের পথে নিয়ে যান, আর যখন অবিদ্যাশক্তির দ্বারা ধরেন, তখন জীবকে একেবারে মুগ্ধ করে রাখেন, হাতে পায়ে দড়ি বেঁধে সংসারে ফেলে দেন।

লীলাশক্তির সহায়ে সেই এক রামকৃষ্ণদেব কিরূপে জীবজগৎ হয়ে বিরাটরূপী হয়েছেন, তার কথা বললাম। আর তাঁর নিরাকার অবস্থা তিনি বলতেন যে, সে কি রকম তা মুখে বলা যায় না। সেখানে জীব-জগৎ নেই, সৃষ্টি নেই, সব উড়ে যায়, সেখানে তুমি যেমন শুনেছ, মায়া ভুল ও ঐন্দ্রজালিক তাই।

মায়া ভুল হয়েও সত্য, আর সত্য হয়েও ভুল, এ সম্বন্ধে পরমহংসদেবের একটি সুন্দর মীমাংসা আছে। তিনি বলতেন, জীবজগৎ যখন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তখন কি করে মিথ্যা বলে বলি। আবার শঙ্করের যে মত, সে মতে জীব-জগৎ থাকে না। মীমাংসার কথা যেটি, সেটি এই: "তাও বটে, নাও বটে"। ঈশ্বরীয় অবস্থার ইতি হয় না, ভগবান এইটি, অপর কিছু নন বা হতে পারেন

৩৫

না, এমন কথা বললে তাঁর ইতি করা হয়, তাঁকে সীমাবদ্ধ করা হয়।

তিনি সব হতে পারেন, তাঁর সম্বন্ধে সব সম্ভব; এই ঠাকুরের মীমাংসা।

পা। পরমহংসদেব এমন ঠাকুর! আচ্ছা, আপনি যে বললেন, রামকৃষ্ণদেবই সেই রাম, সেই কৃষ্ণ, কই তাঁদের মতো তো কোন বেশভূষা কি অলৌকিক কার্য দেখতে পাই না; আর লোকেও কেউ বলে না; তবে হাঁ, তাঁর জল্পনা প্রায় অনেক স্থানে আজকাল হচ্ছে বটে।

ভ। তুমি এ-কথা প্রথমেই বলেছিলে, আবার এখন বলছ। রামকৃষ্ণদেব সম্বন্ধে এখনো তোমার সন্দেহ রয়েছে। তুমি তাঁকে প্রার্থনা কর; তিনি বুঝিয়ে দেবেন, দেখিয়ে দেবেন।

একটা কথা মোটামুটি বলি শুন। অবতারবিশেষে রূপবিশেষ হয়। রাম অবতারে রামরূপ, কৃষ্ণ অবতারে কৃষ্ণরূপ, এবার রামকৃষ্ণ অবতারে রামকৃষ্ণরূপ। সব অবতারে সমান বেশ হয় না ও সমান কাজও হয় না। অবতার দুই রকম। এক অবতার ভূভারহরণের জন্য, সাধুদের পরিত্রাণের জন্য, আর দুষ্টদমনের জন্য। আর এক অবতার - তাঁকে আদর্শাবতার বলে। এই অবতারের কার্য - ধর্মসংস্থাপন করা, জীবকে শিক্ষা দেওয়া, আর পতিতের উদ্ধার করা। আদর্শাবতারে ঐশ্বর্য ব্যক্ত থেকেও থাকে না, বেশ-ভূষার আড়ম্বর থেকেও থাকে না, থাকে কেবল মাধুর্য। আদর্শাবতার নিরৈশ্বর্যে ঐশ্বর্যবান ও অরূপে রূপবান। 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপুঁথি' এই সম্বন্ধে যা বলে, তোমাকে তা শুনাই, শুন:

আরে অবিশ্বাসী মন কি কব তোমাকে।
চিরকাল মগ্ন তুমি সন্দেহের পাঁকে॥

৩৬

যদি না বিশ্বাস তোর, মোর কিবা ক্ষতি।
মুই জানি প্রভু মোর অখিলের পতি॥
ত্রাতা পাতা নেতা পথে হৃদয়বিহারী।
সংসার-জলধি-জলে পারের কাণ্ডারী॥
রতন মাণিক মম প্রাণ বুদ্ধি বল।
সম্পদ-বিপদ-সখা সহায় সম্বল॥
ঐশ্বর্য দেখিয়া তত্ত্ব করিতে নির্ণয়।
তোর মত সন্দ যেন মোর নাহি হয়॥
হউন শ্রীপ্রভুদেব পূজারী ব্রাহ্মণ।
পর-গৃহবাসী কিংবা পরান্নে পালন॥
না হয় হউন তিনি নিরক্ষর বেশ।
অরূপ অগুণ কিবা উন্মত্ত অশেষ॥
না হয় হউন পঞ্চভূত-দেহধারী।
দীন-হীন দ্বিজ-সাজ বালক আচারী॥
বসন-ভূষণহীন সামান্যের ন্যায়।
জীর্ণশীর্ণ কলেবর বেদনা গলায়॥
যত কিছু থাক তাঁর না করি বিচার।
ভজিব পূজিব প্রভু ঠাকুর আমার॥
চাহ তুমি বেশ-ভূষা ঐশ্বর্য দর্শন।
অঙ্গে কান্তি নবদূর্বাদলের বরণ॥
রতন কুণ্ডল কানে লম্বমান বেণী।
বিজড়িত মুকুটেতে নানা রত্নমণি॥
পদে পদে অশ্ব গজ রথ শোভমান।
পৃষ্ঠদেশে তূণ করে ধরা ধনুর্বাণ॥
কনক-বরণা বামে সীতা ঠাকুরানী।
হরধনুভঙ্গলব্ধ জনক-নন্দিনী॥

৩৭

আরে মন নিরৈশ্বর্য দেখে পেলি ধোঁকা।
সেই রাম এই রামকৃষ্ণরূপে ঢাকা॥
চাহ তুমি দেখিবারে শিরে শিখি-পাখা।
শোভিত সুন্দর ভালে অলকা-তিলকা॥
দুলু দুলু গজমতি অতুল নাসায়।
চন্দ্রমা-কিরণ জিনি কৌস্তভ গলায়॥
নয়ন দুখানি বাঁকা আকর্ণ-পূরিত।
কান্তিময় নীল তনু চন্দনচর্চিত॥
মনোহর পীতবাস জড়িত তড়িতে।
ভুবনমোহন বেণু ঠামে ধরা হাতে॥
শ্রীরাধার প্রেমে বাঁকা ত্রিভঙ্গিম ঠাম।
গোপীমন-বিরঞ্জন নটবর শ্যাম॥
দুলে গলে বনমালা আপাদলম্বিত।
পীতধড়া গুঞ্জবেড়া অঙ্গে সুশোভিত॥
কনক নূপুর পায় রুনুঝুনু রব।
রকত উৎপল জিনি চরণ-সৌষ্ঠব॥
পায়ে পায়ে প্রস্ফুটিত কমল-আবলী।
মকরন্দ-গন্ধে ছুটে ঝাঁকে ঝাঁকে অলি॥
আরে মন নিরৈশ্বর্য দেখে পেলি ধোঁকা।
সেই কৃষ্ণ এই রামকৃষ্ণরূপে ঢাকা॥
সেই রাম সেই কৃষ্ণ রামকৃষ্ণ সাজে।
লীলান্তরে রূপান্তর আপনার কাজে॥
রূপান্তর মাত্র কিন্তু গুণান্তর নয়।
মহল্লীলা শ্রীপ্রভুর সাক্ষী পরিচয়॥
যখন যেরূপ সাজ হয় দরকার।
সে রূপে সে সাজে অবতীর্ণ অবতার॥

৩৮

সমভাবে সেই শক্তি বিরাজিত কার্যে।
ঐশ্বর্যবানেতে যেন তেন নিরৈশ্বর্যে॥
ভগবান যে রূপই ধরুন না কেন, তাঁর সেই রূপে তাঁর সব রূপ থাকে। দাতাকর্ণের ঘরে যখন বুড়ো থুরথুরে বামন হয়ে হাজির, তখন কি তাঁর ভিতরে কৃষ্ণরূপ ছিল না? কৃষ্ণাবতারে হনুকে রামরূপ দেখাতে হয়েছিল। রামকৃষ্ণদেবও অনেক রূপ অনেক ভক্তকে দেখিয়েছেন। 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি'তে ইহার বিশেষ বর্ণনা আছে। রামকৃষ্ণরূপ ছাড়া রামকৃষ্ণভক্ত অন্য রূপ দেখতে চান না। একবার ঠাকুর গিরিশবাবুকে বললেন, "তুই কিছু দেখবি?" ভক্ত উত্তর করলেন, "তুমি তার ভিতরে থাকবে তো?" প্রভু বললেন, "আমি আবার তার ভিতরে কেন থাকব?" ভক্ত বললেন, "তবে আমি দেখতে চাই না।" ভগবানের অন্য রূপ দেখে ভগবানকে পরীক্ষা করে নেয়া অপেক্ষা ভগবানে মনের অবিশ্বাস আর কিছুতেই নেই। তবে রামকৃষ্ণদেব সন্দিগ্ধচিত্তের সংশয় বিমোচনের জন্য অনেক পরীক্ষা দিয়েছেন ও অনেক রূপ দেখিয়েছেন।
রামকৃষ্ণদেবকে দর্শন করলে সব অবতারকে দর্শন করা হয়। তাঁকে বুঝলে যাবতীয় বেদ, বেদান্ত, পুরাণাদি ও জগতে যত ধর্ম আছে, সকলেরই মর্ম অবগত হতে পারে। রামকৃষ্ণদেবের দেহে সমস্ত জগৎব্রহ্মাণ্ড - সৃষ্টিটি আছে।
আ মরি কি মনোহর,        সমাধিস্থ কলেবর,
নিশাকর বদন-মণ্ডলে।
অপরূপ শোভা পায়,        কিরণ-হিল্লোল তায়,
ঝলকে ঝলকে যবে খেলে॥
নিরখি শ্রীমুখ-ইন্দু,        অন্তরের প্রেমসিন্ধু,
আঁধার ছাড়িয়া ছুটে যায়।

৩৯

তোড়ে ভাসে তার জলে,        বহু দূর-দূরাঞ্চলে,
দুই কূলে যে রহে যেথায়॥
কত পথে ছুটে ঢেউ,        সন্ধান না জানে কেউ,
বিধিরও বিধানে নাহি লেখা।
মায়া ঈশ্বরের শক্তি        অদ্ভুত তাঁহার কীর্তি,
লীলার ভিতরে আছে ঢাকা॥
কোথা সূর্য কত দূরে,        কেমনে বিমানে করে,
লবণাম্বু লইয়া সিন্ধুর।
অলক্ষ্যে চালিয়ে কল        ফটিক-নির্মল জল,
চাতকের তৃষা যাহে দূর॥
ধরায় জলধিমালা,        শূন্যমার্গে করে খেলা,
ধরিয়া জলদ নামান্তর।
এ বড় বিষম দায়,        কিছুই না বুঝা যায়,
কেবা কিবা কোথা কার ঘর॥
এক শক্তি মোটে মূলে,        কার্যেতে ভিয়ান তুলে,
লক্ষ কোটি সৃষ্টি রকমারি।
দুটি বস্তু সমরূপ,        বিশ্বমধ্যে অপরূপ
শক্তির শকতি বলিহারি॥
একে নাহি মিলে অন্য,        সকলেই ভিন্ন ভিন্ন
তারে গুণে গঠনে বরণে।
অবিনাশী যাবতীয়,        নাহি কিছু শ্রেয়ঃ হেয়,
রূপান্তর গুণান্তর বিনে॥
চতুর্মুখ হরি হর,        যে শক্তির আজ্ঞাপর,
হয় লয় যাহার ভিতরে।
সেই শক্তি দিবানিশি,        শ্রীপ্রভুদেবের দাসী,
যুক্তকর লীলার আসরে॥

৪০

হেন প্রভু বিশ্বপতি,        তাঁহার লীলার গতি,
সাধ্য কার করে নিরূপণ।
আকাশ মাটির সনে,        মিশে গেছে যেইখানে,
সে নয় তাদের আয়তন॥
শ্রীপ্রভুর লীলা-রাজ্য,        মহতী অব্যক্তাশ্চর্য,
আদি-অন্ত-বিহীন আভাস।
অবিরত যুক্ত করে,        যাবতীয় অবতারে,
নিরাপদে মধ্যে করে বাস॥
রাজ-রাজ রামকৃষ্ণ,        বিচারে সকলে তুষ্ট
বিবাদ-বিদ্বেষ-বিভঞ্জন।
যার যাহা অধিকার,        তিল নহে নষ্ট কার,
সমভাবে সকলে পালন॥
গোকুল বেদান্ত আদি,        যেখানে যাবৎ বিধি,
মত পথ ব্যক্ত চিরকাল।
সকলে ধরিয়া বক্ষে,        সমান যতনে রক্ষে,
কৈলা প্রভু বিশ্ব ধর্মপাল॥

রামকৃষ্ণদেবের সব অলৌকিকত্ব। তাঁর গোটা জীবনটি অলৌকিকত্বে ভরা। তাঁর লৌকিকত্ব কিছুই নেই। তাঁর কথা এখন পর্যন্তও কিছুই হয়নি। আমি যখন লীলাকথা বলব, তখন তোমাকে দেখিয়ে দিয়ে যাব যে, আজ পর্যন্ত অর্থাৎ রামকৃষ্ণদেব অবতীর্ণ হবার পূর্বে যত অবতার হয়েছেন, আর তাঁরা যা করেছেন একা রামকৃষ্ণদেব সেই সব করেছেন, আবার তার চেয়ে কিছু বেশি করেছেন। এখন কেবল তোমাকে রামকৃষ্ণদেবের দুই-চারিটি উক্তি-গীতা বলছি মাত্র।

এই উক্তি-গীতা রামকৃষ্ণদেবের মহামন্ত্র-বাক্য। এই উক্তিগুলির ভিতরে রামকৃষ্ণদেব বিশ্বজনীন ধর্মের সারতত্ত্ব রেখে গেছেন। মাঘের হিমানী পরমাণুরূপে পড়ে, কিন্তু সেই হিমানীর এত শক্তি যে, পাষাণ

৪১

জরিয়ে ফেলে, তেমনি রামকৃষ্ণদেবের অতি সরল কথায়, সরল গীতার ভিতর এমনি শক্তি নিহিত আছে যে, অতি বড় পাষাণচিত্ত বদ্ধজীব শুনলেও তার অন্তরে অন্তরে, মজ্জায় মজ্জায়, শিরায় শিরায়, অস্থিতে অস্থিতে প্রবেশ করবে।

একটি বিষয়কে নেড়েচেড়ে না দেখলে বুঝা যায় না। পরমহংসদেবের মহিমা যে এখনও এ দেশের লোক দেখতে পাননি, তার কারণ কেউ তাঁকে দেখেননি। তাঁর মূর্তিমান জ্বলন্ত মহিমার মধ্যে থেকে মহিমা দেখতে পাইনি বলাও যা, আর হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে দাঁড়িয়ে থেকে শীত লাগছে না বলাও তা। যাঁদের এমন স্থলেও শীত বোধ হচ্ছে না, তাঁদের বুঝতে হবে যে, তাঁদের শরীরে কিছু বিকার জন্মেছে।

একজন দীন-দুঃখী ব্রাহ্মণের ছেলে, নিরক্ষর কৈবর্তের ঠাকুরবাড়ির পূজারী বামুন এমন সকল কথা বলে গেলেন, এমন একটি জীবন দেখিয়ে গেলেন যে, সেই কথায়, সেই জীবনের আভাস পেয়ে ভূমণ্ডলের চতুর্দিকের অতি উন্নতিশীল জাতির বড় বড় পণ্ডিত, বড় বড় বৈজ্ঞানিক, বড় বড় ধর্মতত্ত্ববিদ্ মহামান্যেরা মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বা অতি ভক্তিসহকারে তাঁর লীলাস্থান অর্থাৎ কোনখানে তিনি থাকতেন, কোনখানে তিনি বসতেন, কোনখানে তিনি শুতেন, কোনখানে কে তাঁর বিষয় জানেন, কে তাঁর সঙ্গে থাকতেন, সেই সব স্থানও দেখবার জন্য লোক সাত সমুদ্র পার হয়ে দীনভাবে এখানে আসছেন। রামকৃষ্ণদেব যে গাছের তলায় বসে অগণ্য সাধন করে যাবতীয় ধর্মের গূঢ়তত্ত্ব অবগত হয়েছেন, সেই গাছের পাতা, সেই সিদ্ধস্থানের মাটি কত হাজার হাজার লোক আপন আপন দেশের আপন বাটীতে নিয়ে গিয়ে গ্লাসকেসের ভিতর রেখে আপনাকে পবিত্র মনে করছেন। যে দেশের লোক হিন্দুদিগকে হীনবীর্য মনে করেন, পশু অপেক্ষাও নীচ মনে করেন, যে দেশের

৪২

লোকেরা হিন্দুদিগকে পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বী বলে মনে প্রাণে ঘৃণা করেন, যে দেশের লোক বহুকালাবধি পাদরী ধর্মোপদেষ্টা এ দেশে পাঠিয়ে হিন্দুদিগকে আলোয় নিয়ে যেতে ব্যবস্থা করেন, আজ সেই সেই দেশের উন্নতিশীল তত্ত্বপিপাসুরা রামকৃষ্ণদেবকে যে ভক্তিপূর্বক পূজা করছেন, ইহা কি একটি লৌকিক অপেক্ষা অলৌকিক ব্যাপার নয়?

বিদেশীয় পণ্ডিতমণ্ডলী যখন পরমহংসদেবকে এরূপ পূজ্য আরাধ্য বলে বুঝেছেন, তখন এটা বুঝতে হবে যে, তাঁরা পরমহংসদেবের ভিতরে একটা নূতন আলো দেখতে পেয়েছেন। এখন জিজ্ঞাসা করি, বল দেখি সকল দেশে সকল জাতিকে, সকল ধর্মপন্থীকে, সকল তত্ত্বপিপাসুকে যিনি সমানভাবে আলো দেন, তিনি কে? অতি মূর্খকেও চির অন্ধকেও স্বীকার করতে হবে যে, তিনি জগদ্গুরু রামকৃষ্ণদেব। সেই চাঁদামামা রামকৃষ্ণদেব। তিনি যে কি ধর্ম দেখিয়ে গেলেন, যথাসাধ্য তা পরে বলব। রাম ও কৃষ্ণ যে রামকৃষ্ণদেব হয়ে জগৎকে মুগ্ধ করেছেন, এ কি তাঁর মহিমা নয়? এখানের লোক দেখতে যদি না পায়, তাহলে বলতে হবে, হয় তাদের চোখ-কানের বিকার ঘটেছে, কি বুদ্ধি বিগড়ে গেছে - নয় কোন কারণে দেখাশুনার পক্ষে একটা বাধা পড়েছে।

হাজার হাজার লোকের চোখ-কানের বুদ্ধির বিকার, একথা বললে আমার ছোট মুখে বড় কথা বলা হয়। তবে এ পর্যন্ত বলবার অধিকার আছে যে, যাঁরা রামকৃষ্ণদেবকে দেখবেন, তাঁরা যেন সরল প্রাণে, সাদা মনে ও সহজ বুদ্ধিতে দেখেন। যে বুদ্ধিতে মানুষ ভগবান হারিয়েছেন, যে বুদ্ধিতে পরনিন্দা পরগ্লানিকে সৎ জল্পনা বলে বুঝে রেখেছেন, যে বুদ্ধিতে অন্তরে দ্বেষ-হিংসার আগুন জ্বেলে রেখে পরম শান্তি ভোগ করছেন বলে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন, যে বুদ্ধিতে মিথ্যা শঠতা প্রবঞ্চনাকে ঠাঁই দিয়ে গজমতিহার

৪৩

পরেছি বলে বুঝে রেখেছেন, যে বুদ্ধিতে কাম-কাঞ্চনের ক্রীতদাস হয়ে সমাজের গণ্যমান্য বলে বুঝে রেখেছেন, যে বুদ্ধিতে মনুষ্যত্বের বিনিময়ে পশুত্বে অভিষিক্ত হয়ে আপনাকে গৌরবান্বিত বলে মনে করে রেখেছেন, যে বুদ্ধিতে প্রাণ ভরে একবার মা বলে ডাকতে পারেন না, এমন অসরল, অপবিত্র, কূট, হীনবুদ্ধি নিয়ে, সেই সৎ অপেক্ষা সৎ, শুদ্ধাপেক্ষা শুদ্ধ, পবিত্র অপেক্ষা পবিত্র রামকৃষ্ণদেবকে দেখতে গেলে কি দেখবেন? দেখবেন, তিনি কৈবর্তের ঠাকুরবাড়ির পূজারী বামুন, একজন পাগল, কতকগুলি বাপে খেদানো ও মায়ে তাড়ানো, সমাজচ্যুত, হেয়, মূর্খ, বকাটে লোকের গুরু, আর শেষে তিনি গলার পীড়ায় দেহ রাখলেন।

আমি মানুষের চোখ-কানের বিকারের কথা বললাম। এখন কিসে বাধা দিয়েছে, তার কথা শুন। একদিন দক্ষিণেশ্বরে গ্রীষ্মকালে পঞ্চবটীর শীতল ছায়ায় রামকৃষ্ণদেবের কাছে তাঁর কতকগুলি ভক্ত বসে আছেন। নানা রকমের ঈশ্বরীয় কথা হচ্ছে, এমন সময় কথায় কথায় এঁড়েদহ, দক্ষিণেশ্বর ও বরাহনগরের লোকদের কথা উঠল। ঠাকুরের উপর এঁদের জটিলা কুটিলার ভাব; তাই একটি ভক্ত কৌতূহলাক্রান্ত হয়ে ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কত দূর-দূরান্তরের লোক এসে এখানে শান্তিলাভ করে যাচ্ছেন, আর এরা আসেন না কেন?' ঠাকুর মুখে কোন জবাব না দিয়ে, একটি গাই দড়াবাঁধা ছিল, সেই গাইটিকে দেখিয়ে দিলেন। গাইটি গঙ্গার গর্ভে চরায় দড়াবাঁধা ছিল; এখন গঙ্গার জলের দিকে তাকিয়ে ছটফট করছে। গাইটি দেখে কথার জবাব তখন কেউ বুঝতে পারলেন না। রামকৃষ্ণদেবের কি মহিমা! এমন সময় আর চার-পাঁচটি ছাড়া গরু এসে গঙ্গার জলে নেমে গিয়ে ইচ্ছামত জল খেয়ে ডাঙায় উঠল। তখন ঠাকুর বুঝিয়ে দিলেন যে, ঐ গাইটির ভারি তৃষ্ণা পেয়েছে, কিন্তু বাঁধা রয়েছে, তাই এত কাছে জল তবু খেতে পাচ্ছে না; আর ঐ গরুগুলি ছাড়া

৪৪

ছিল, তাই তৃষ্ণা পাবামাত্র জল খেয়ে গেল। এখানকার লোকেরা বাঁধা আছে, তাই আসতে পারে না।

ঠাকুর এ সম্বন্ধে আর একটি কথা বলতেন, 'লণ্ঠনের নিচে অন্ধকার থাকে, দূরে আলো পড়ে'। সেই রকম মহাপুরুষদের কাছের লোকেরা তাঁকে দেখতে পায় না, দূরের লোকেরা তাঁর ভাবে মুগ্ধ হয়। ঠাকুর আর একটি উপমা দিতেন, বলতেন যে বাজ-বাটুলের বীচি তলায় পড়ে না, যোজনান্তর দূরে ছিটকে পড়ে আর সেখানে গাছ হয়। সেই রকম মহাপুরুষদের ভাব দূরে প্রকাশ পায় ও লোকে আদর করে।

শেষ কথা। জীব চার প্রকারের - নিত্যমুক্ত, মুক্ত, মুমুক্ষু আর বদ্ধ। নিত্যমুক্ত আদতে মায়ার জালেই পড়ে না। মুক্ত জাল কেটে পালায়। মুমুক্ষু কিসে জাল কাটতে পারে, তার চেষ্টা করে আর বদ্ধ জালে পড়েছে, কিন্তু পালাবার মোটেই চেষ্টা নাই, বরং কাদার ভিতর লুকুতে চায়। বদ্ধজীবের লক্ষণ - কাম-কাঞ্চন বই যে আর কোন জিনিস আছে, তা তার আক্কেলেই নেই। অর্থ উপায় করা, খাওয়া মাখা পরা আর বংশবৃদ্ধি করা এটিই সে জীবনের সার উদ্দেশ্য বুঝেছে।

ভূতে যেমন রামনাম শুনতে পারে না, বদ্ধজীবও তেমনি ভগবানের কথায় কানই পাতবে না, বলবে - শুনলে কি হবে? চল, বরং খানিক ইয়ারকি দিয়ে আসি। কেউ বলে - চল, ঘরের কাজকর্ম দেখি, ওসব শোনবার সময় আছে, সে বুড়ো বয়সে। এ যাদের কথা, তারা তো বাপের ঠাকুর; আবার কেউ কেউ এমন কথা বলে যে, শুনলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। বলে - 'কৃষ্ণ করেছিলেন তাই লীলা, আর আমরা করলেই বদমায়েসি।' এ-সকল লোকের কাছে যদি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ চূড়া-ধড়া পরে, হাতে বাঁশী নিয়ে, রাইকে বামে করে এসে দাঁড়ান, তবু বিশ্বাস করবে না, বরং বলবে - 'হ্যাঁ

৪৫

গা! তোমরা কোন্ থিয়েটারের - বেশ পোশাকগুলি করেছ তো'! অবতারে বিশ্বাস হওয়া বড় শক্ত। ডাক্তার সরকার অত বড় লোক, তিনি ঠাকুরের কাছে বলেছিলেন যে, যিনি চোরাবাণে বালীকে মেরেছেন, যিনি পাঁচমাসের গর্ভবতী স্ত্রীকে বনে দিয়েছেন, এমন রামকে আমি ভগবান বলতে পারব না।

আর একটা বাধার কথা বলি, শুন। এখনকার লোকে ভারি লেখাপড়া শিখে। সকলেই পণ্ডিত। অনেক পড়ে পাণ্ডিত্যাভিমানে হৃদয়টি ভরতি করে রেখেছে। বিদ্যাধ্যয়নে যিনি নিরহঙ্কার হন, তাঁর অধ্যয়নই অধ্যয়ন, আর এই বিদ্যাধ্যয়নে অবিদ্যার পাক খোলে। বিদ্যার উদ্দেশ্যই তাই। বিদ্যা মহাবিদ্যাকে দেখিয়ে দেয়, কিন্তু যেখানে পাণ্ডিত্যাভিমান এসে জুটল, সেখানে আরও অবিদ্যার প্যাঁচ বেশি লাগল। এই বিদ্যার অহঙ্কারে তাঁর সর্বনাশ যে হয়েছে, এটা তাঁকে আর জানতে দেয় না। অহঙ্কারই একমাত্র ঈশ্বর-পথের কণ্টক। এই অহঙ্কারই মূর্তিমতী অবিদ্যা।

অহঙ্কার অনেক রকমে হয়, কেবল সরস্বতীর করুণাতেই যে হয় তা নয়, লক্ষ্মীর কৃপাতেও খুব হয়। আবার দুই বোন এক জায়গায় যেখানে, সেখানের তো কথাই নেই। অহঙ্কার মানের হয়, কুলের হয়। অবিদ্যা নানাদিকে নানারঙ্গের ডুরি ছেড়েছেন, যাদের যেমনি পেয়েছেন, তাদের তেমনি বেঁধে কাবু করেছেন।

পা। পরমহংসদেবের পরীক্ষা দেবার কথা কি বললেন? তাঁর পরীক্ষা দেওয়া কি রকম?

ভ। সে অনেক কথা, আচ্ছা শুন। দক্ষিণেশ্বরের রানী রাসমণির কালীবাড়িতে পরমহংসদেবের ভ্রাতা রানীর জেদে মা-কালী ভবতারিণীর নিত্য পূজা ও সেবায় ব্রতী হন। তখন পরমহংসদেব জ্যেষ্ঠের নিকটে মধ্যে মধ্যে থাকতেন। একদিন বেড়াচ্ছেন, এমন সময় রানীর জামাই মথুরবাবু সেই জগন্মোহন-কান্তিমাখা-কলেবর, ঈষৎ-রক্তিমাধর,

৪৬

ঈষৎ-বঙ্কিমনয়ন, বিশালবক্ষ, আজানুলম্বিতবাহু, বালার্কবৎ রামকৃষ্ণকে দর্শন করে একেবারে মনেপ্রাণে আকৃষ্ট হন। সোৎসাহে অপরের কাছে পরিচয় জিজ্ঞাসা করে জানলেন, ইনি বড় ভটচায মহাশয়ের কনিষ্ঠ। মথুরবাবু কনিষ্ঠকে তাঁর কাছে ডেকে আনতে ও মা-কালীর পূজায় ব্রতী করতে জ্যেষ্ঠকে বিনয় সম্ভাষে অনেক জিদ করেন। জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠের নিকট মথুরবাবুর অভিপ্রায় প্রকাশ করায় কনিষ্ঠ বললেন, 'আমি বড়মানুষের কাছে যেতে, কি পূজায় ব্রতী হতে পারব না।' মথুরবাবু যথাসাধ্য চেষ্টা করে অকৃতকার্য হয়ে দিনকতক চুপ করে রইলেন।

ঠাকুর রামকৃষ্ণ ছেলেবেলা থেকে সুন্দর সুন্দর মাটির দেবদেবীর প্রতিমূর্তি গড়তে জানেন। মৃন্ময় মূর্তিতে চক্ষুদান দেওয়া তাঁর একটি বিশেষ মহিমা ও শক্তি ছিল। চক্ষুদানে মাটির মূর্তি জীবন্ত বোধ হতো। দেশে গ্রামে পূজোপলক্ষে প্রতিমা গড়া হলে আগে গদাই ঠাকুরকে দেখানো হতো। ঠাকুরের বাল্য নাম গদাই। তিনি প্রতিমার গঠনদোষ দেখিয়ে দিতেন, কিন্তু চক্ষুদানটি তিনি নিজে না দিলে কারও মনঃপূত হতো না।

তাঁর ভাই যেখানে থাকেন সেখানে রামকৃষ্ণ একটি গঙ্গামাটির শিব ও একটি বৃষ গড়ে রেখে দিয়েছেন। ঘটনাক্রমে সেটি মথুরবাবুর চোখে পড়ে গেল। তিনি শিবটি ও ষাঁড়টি দেখে ঠিক জীবন্ত বলে মনে করলেন, এবং কে গড়েছে, সেই খবরটি নিয়ে রানীকে গিয়ে দেখালেন আর বললেন, এটি যাঁর গড়া, তাঁকে যদি মা-কালীর পূজায় রাখা যায়, তাহলে তিনি শীঘ্রই মা-কালীকে জাগ্রত করতে পারবেন। এই মনে করে তিনি ঠাকুরের জ্যেষ্ঠকে বিশেষ অনুরোধ করলেন এবং বললেন, 'আপনার ভাইকে মা-কালীর পূজায় রাখতেই হবে।' বড় ভাই বারবার জিদ করায় ঠাকুর আর না বলতে পারলেন না। বললেন, যদি হৃদুকে সহ রাখা হয়, তাহলে আমি থাকব।

৪৭

মথুরবাবু সে কথা শুনে আনন্দে আটখানা হয়ে ঠাকুরের আর হৃদয়ের মাসিক বেতন ধার্য করে পূজায় নিযুক্ত করলেন।

মথুরবাবু মাঝে মাঝে ঠাকুরের কাছে ঈশ্বরীয় কথা আর তাঁর বীণা-বিনিন্দিত কণ্ঠের গান শুনেন। এই রকমে কিছু দিন কেটে গেল।

ঠাকুর মা-কালীর বেশকারী হলেন। নিত্য নিত্য মা-কালীর নূতন নূতন বেশ করেন। মথুরবাবু ও রানী দেখে আশ্চর্য হন। তারপর ঠাকুর পূজার কাজ নিলেন। দিন দিন পূজা করতে করতে তাঁর মনে রকম রকম ভাব উঠতে লাগল। মাঝে মাঝে বাহ্য জগৎ নেই বলে মনে হতে লাগল, আবার কখনো কখনো নিজের শরীরবোধ পর্যন্ত ভুল হতে লাগল। মনখানি মায়ের পিছু পিছু ছোটে আর রসনাটি আকুল হয়ে মা মা করে। কখনো কখনো মা মা বলে এত কাঁদেন যে, চোখের জল মেঝেতে পড়ে। কখনো কখনো মায়ের গায়ে কেবলই চামরব্যজন করতে থাকেন, আবার কখনো মাখন মিছরি নিয়ে 'মা, তুই খা মা' এই বলে মা-কালীর মুখের কাছে ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। কখনো কখনো পূজা করতে গিয়ে মায়ের পায়ে ফুল না দিয়ে, আপনার মাথায় দিয়ে বাহ্যহারা হয়ে বসে থাকেন, কখনো বা মা-কালীর নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা দেখবার জন্যে নাকের কাছে তুলো ধরেন। কোন দিন বা আরতির সময় কাঁসর-ঘণ্টা-বাদ্য শেষ হলো, নহবত নিস্তব্ধ হলো, কিন্তু ঠাকুরের হাতের ঘন ঘন ঘণ্টা-রব ও পঞ্চপ্রদীপের চালনা আর থামে না। ঠাকুর যেন কলের পুতুল! হৃদয় ঠাকুরের আবেশ বুঝতে পেরে তাঁকে ধরেন, আর ঠাকুর বাহ্যহারা হয়ে যান। কালীবাড়ির বামুনরা মূর্ছারোগ বুঝলেন। এত দিন ঠাকুর মানুষের চোখে মানুষ ছিলেন, এবার পাগল হলেন। সাধারণের প্রকৃতির সঙ্গে না মিললেই পাগল!

ক্রমে ঠাকুরের ভাব-মহাভাব দিনের মধ্যে অনেকবার হতে লাগল।

৪৮

কালীবাড়ির বামুনরা এখন পাকা বুঝলেন যে, ঠাকুর মূর্ছা ও উন্মাদ-রোগগ্রস্ত। ঠাকুর অকর্মণ্য বলে মথুরবাবুর কাছে বলতে লাগলেন। মথুরবাবু মনে মনে নানারকম ভাবেন, কিন্তু মুখে কিছু বলতে সাহস করেন না।

রামকৃষ্ণদেবের মহিমা! এমন সময়ে দক্ষিণেশ্বরে এক ব্রাহ্মণী এসে জুটে গেলেন। এই ব্রাহ্মণী অদ্ভুত ক্ষমতাশালিনী। ভক্তিগ্রন্থ, পুরাণ, তন্ত্রাদি এঁর সব কণ্ঠস্থ। তান্ত্রিকমতে যাবতীয় সাধন-প্রণালী বিশেষ রকম জানেন। ঠাকুর ঐ ব্রাহ্মণীর কথা একবার বলেছিলেন যে, তিনি চতুর্বেদ-মূর্তিমতী। ব্রাহ্মণী ঠাকুরের অঙ্গে ভাব মহাভাব দেখেই তাঁকে ভগবান বলে চিনতে পারলেন, আর কালীবাড়িতে ঐ কথা রাষ্ট্র করতে লাগলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণীর কথা প্রথমে কেউ গ্রাহ্য করলেন না। তারপর যখন শাস্ত্রের প্রমাণ দিয়ে লম্বা চৌড়া শ্লোক আওড়াতে লাগলেন, তখন মথুরবাবুর চমক লাগল। শাস্ত্রে ব্রাহ্মণীর বিলক্ষণ পারদর্শিতা দেখে মথুরবাবু অবাক হয়ে গেলেন, আর পরীক্ষা করবার জন্যে বড় বড় পণ্ডিত এনে তাঁর সঙ্গে বিচার করতে লাগলেন। ব্রাহ্মণীর কণ্ঠে যেন সরস্বতীর আবির্ভাব হলো, কোন পণ্ডিতই বিচারে হারাতে পারলেন না। শাস্ত্রে ভাব মহাভাবের যেসব লক্ষণ আছে, সেসব বাক্য ও শাস্ত্রের প্রমাণ দিয়ে আর পরমহংসদেবের মহাভাবের সময় তাঁর অঙ্গে সেসব লক্ষণ দেখিয়ে দিয়ে ঠাকুরকে ভগবান বলে সাব্যস্ত করলেন। পণ্ডিতেরা শাস্ত্রের উক্তিতে ও ঠাকুরের ভাবের লক্ষণে দেখলেন যে, সব মিলে যাচ্ছে, কিন্তু তবুও ঠাকুরকে ভগবান বলে স্বীকার করলেন না। পণ্ডিতদের পরাজয়ে ব্রাহ্মণীর বাক্যে মথুরবাবুর অনেক বিশ্বাস হলো ও ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি বাড়ল, তখন তিনি মা-কালীর পূজা থেকে ঠাকুরকে মুক্তি দিয়ে, মা-কালীর সেবার যেমন বন্দোবস্ত তেমনি ঠাকুরের সেবার বন্দোবস্ত করে দিয়ে নিজের বৈঠকখানায় দোতলার উপর তাঁকে রেখে দিলেন।

৪৯

হাজার হোক মানুষের মন, তাই মথুরের মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। রাত্রিকালে পরমা সুন্দরী বেশ্যা এনে ঠাকুরের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করেন।

পা। পরমহংসদেব বেশ্যাদের দেখে কি করতেন?

ভ। শিশুমতি বালক নির্জনে হঠাৎ একটা ভয়ঙ্করী রাক্ষসী দেখলে যেমন মা মা করে আর ভয়ে জড়সড় হয়, তেমনি ঠাকুর মা মা করে একেবারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে যেতেন।

পা। আর ঐ বেশ্যারা?

ভ। বেশ্যারা কেউ চিৎকার করে পালিয়ে যেত, কেউ বা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদত। মথুরবাবু বেশ্যা লাগিয়ে একবার ঠাকুরের ভারি শক্ত পরীক্ষা করেছিলেন। লছমীবাঈ বলে এক বেশ্যা ছিল - সে মুনির মন টলাতে পারত। সে সুন্দরীও যেমনি, তার ঘর-দুয়ার সাজসজ্জাও তেমনি, ঠিক যেন অপ্সরী। মথুরবাবু একদিন তার সঙ্গে পরামর্শ করলেন, 'তুমি অমুক দিনে সন্ধ্যার সময় তোমার মতো আর পনের জন সুন্দরীকে বেশ করে সাজিয়ে তোমার ঘরে এনে রেখো, আমি ছোট ভটচাযকে সঙ্গে নিয়ে যাব। কেউ ওঁর মন টলাতে পারেনি, যদি তুমি পার তাহলে আমি বিশেষ পুরস্কার দেব।' সে বললে, 'এটা আর আশ্চর্য কি? কত বড় বড় মাথা মুড়িয়েছি, এ অতি সামান্য কথা।'

তারপর নির্ধারিত দিনে বাঈজী তার ঘরে যত সাজ বেশ ছিল সব গায়ে দিয়ে আর ঐ রকম পনের জনকে সঙ্গে নিয়ে যত রকমের ফাঁদ আছে, সেগুলি সব যোগাড় করে নিয়ে বাঘিনী শিকার ধরবার জন্যে যেমন থাবা গেড়ে বসে থাকে, সেও সেই রকম করে রইল। মথুরবাবু বিকালবেলায় ফিটন-গাড়িতে বড় বড় দুটো ঘোড়া জোতালেন, আর ঠাকুরকে বললেন, 'চল বাবা! গড়ের

৫০

মাঠে বেড়িয়ে আসি।' ঠাকুর রাজি হলেন। মথুরবাবু গড়ের মাঠে বেড়িয়ে ঠিক সন্ধ্যার পর যথাস্থানে উপস্থিত। বাহির থেকে খবর নিলেন, সব ঠিক। মথুরবাবু ঠাকুরকে সেই ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে সরে পড়লেন।

পা। ঠাকুর কি করলেন?

ভ। ঠাকুর ঘরে ঢুকেই মা মা করে গীত গাইতে গাইতে সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন; একমাত্র পরিধেয় বস্ত্রখানি কোমর থেকে খসে গেল; ঠাকুর দিগম্বর।

পা। আর বেশ্যারা?

ভ। বেশ্যাদের বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ। কেউ বাতাস করতে লাগল, কেউ কি করবে বুদ্ধিহারা হয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ বা মুখে জল দিলে, আর কেউ কেউ 'মথুরবাবু, মথুরবাবু' বলে চিৎকার করতে লাগল। মথুরবাবু তাদের চিৎকার শুনে বুঝলেন, একটা কি ঘোর বিপদ হয়েছে। এসে দেখেন, ঠাকুর সমাধিস্থ। বেশ্যারা মথুরবাবুকে বকতে লাগল, আর বলল, "আহা! এমন ছেলে-মানুষকে কি এমন করতে হয়।" মথুরবাবু তাদের শান্ত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠাকুরের যেমনি বাহ্য চেতন এল অমনি সেই আবেশ অবস্থায় তাঁকে গাড়িতে নিয়ে পালিয়ে এলেন।

তারপর মথুরবাবু লজ্জায় আর ঠাকুরের কাছে মুখ দেখাতে পারেন না। মহা বিপদ!

পা। কি আশ্চর্য! মানুষ যদি সুন্দরী যুবতীকে দেখে, তা হলে লজ্জা কুলশীল মনুষ্যত্বের বাইরে বেরিয়ে পড়ে, আর এখানে ঐ রকম ষোলটা! আমার তো এই কথা শুনে বেশ মনে লাগছে যে, বাস্তবিক ভগবান ভিন্ন এমন ধারা কেউ পারে না। আমরা থিয়েটারের লোক, আমাদের ঐ বিষয়ে মানুষ চিনতে তো বাকি নেই।

৫১

পা। কাঞ্চন দিয়ে কি কখনো পরীক্ষা হয়েছিল?

ভ। মথুরবাবু ঠাকুরকে একবার ৫০,০০০ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চান, ঠাকুর তাতে অস্বীকার করায় মথুরবাবু বলেন, 'বাবা, তুমি যদি নিজে না নাও, তাহলে হৃদুর নামে কোম্পানীর কাগজ কিনে দিই।' ঠাকুর অতি বিরক্ত হয়ে বলেন, 'আমি তাও পারব না। হৃদুর নামে থাকলেও আমার এমন মনে হতে পারে যে, ও আমার টাকা, হৃদুর নামে আছে মাত্র।' ভাই, ঠাকুরের ত্যাগের আদর্শ দেখ, ত্যাগ - কায়-বাক্য-মনে। বাক্য বলছে লব না, মনও তাই, আবার কায়াখানিও বলছে লব না। ঠাকুরের কায়ে ত্যাগের বিষয় চক্ষে দেখা। শ্রীহস্তে টাকা কি পয়সা ছুঁইয়ে দেবামাত্র হাত এঁকে বেঁকে যেত ও জড় জিনিসের মতো অনেকক্ষণ অসাড় হয়ে থাকত! এ অদ্ভুত ত্যাগের কথা কি কেউ কখনো শুনেছ!!

আর একবার লক্ষ্মী মাড়োয়ারী টাকা দেবার জন্য মহা পীড়াপীড়ি করে। ঠাকুরকে কোনমতে রাজি করাতে না পেরে একদিন টাকার তোড়া নিয়ে হাজির। ঠাকুর টাকা দেখে ছোট ছেলের মতো চিৎকার করেন, অবশেষে বাহ্যহারা! লক্ষ্মী মাড়োয়ারী এই না দেখে কি একটা মনে করে তোড়া নিয়ে একেবারে পালিয়ে গেল। মথুরবাবু আরও অনেক ঘটনাতে দেখেছিলেন যে ঠাকুর যেমনি কামিনীতে অনাসক্ত, কাঞ্চনেও তেমনি। ঠাকুরের কাঞ্চনেতে অনাসক্তি দেখে মথুরবাবু নিজে মুক্তহস্ত হয়ে গেছলেন। এসব ঘটনা পরে বলব।

পা। ভগবানকে দর্শন করলে সন্দেহ-মোচন হয়; সর্বদা কাছে থেকেও মথুরবাবুর এত সন্দেহ ছিল কেন?

ভ। মথুরবাবু মা-কালীর পরম ভক্ত, তিনি চিরকেলে ভক্ত, জন্ম জন্ম মায়ের ভক্ত, এখন তিনি রামকৃষ্ণলীলায় কাজ করবেন বলে ঠাকুরের সঙ্গে আছেন। তাঁর মনে কোন সন্দেহ নেই। তবে জীবকে শিক্ষা দেবার জন্য মথুরবাবুর মনে সন্দেহ দিয়ে ঠাকুর তাঁর সঙ্গে

৫২

এই রকম খেলছেন। তিনি দেখাচ্ছেন, মানুষের দুর্বলতা কতদূর দেখ। তিনি দেখাচ্ছেন, মানুষের মনখানা কি রকম দেখ আর নিজে পরীক্ষা দিয়ে দেখাচ্ছেন, ভগবান কেমন দেখ, তিনি নরদেহে এসে কি রকম লীলা করেন দেখ। ভাই, মানুষের ভিতরে এই যে মনখানি আছে, এ বড় মুশকিলে জিনিস। আবার ঐ মন যদি সোজা হয় তাহলে এমন সুন্দর আর নেই।

পা। মনটা কি? মন, মন, চিরকাল বলি বটে, কিন্তু জিনিসটা কি, তা তো কই কিছু দেখতে শুনতে পাই না।

ভ। তুমি মাঝে মাঝে বড় শক্ত কথা তুলছ। আমি মুখ্যু মানুষ, তোমাকে মনের কথা কি বলব, তবে ঠাকুর যেমন দেখাচ্ছেন, তেমনি বলি শোন।

বিলাতী যাদুকরের মধ্যে উইলসন উৎকৃষ্ট যাদুকর। উইলসন সব ভেল্কী জানে কিন্তু ভেল্কীখেলা একলা হয় না বলে তাকে অপরকে সেই নিজের ভেল্কী শেখাতে হয়। যারা শেখে, তাদের মধ্যে এক একজন এমন উতরে যায় যে, সে উইলসনের প্রায় সমতুল্য দক্ষ হয়ে পড়ে। এখানেও তেমনি রামকৃষ্ণদেবের একটি শক্তি আছে, সেই শক্তির স্বভাব - খালি দুনিয়াতে ভেল্কী খেলা। এই শক্তি যাদের নিয়ে ভেল্কী খেলে, তার প্রধান চেলা এই মনখানি। মনখানা সেই শক্তির সর্দার খেলুড়ে। মনের খেলা দেখতে পেলে, বুঝতে পারলে, তুমি দুনিয়ার খেলা বুঝতে পারবে ও দেখতে পাবে।

পা। আপনি ভেঙে বলুন, এ হেঁয়ালির মতো লাগছে।

ভ। এ মন একটা ভারি মজার জিনিস। এর এক কর্ম খেলা। এ খালি খেলতে চায়। প্রত্যেক মানুষের ভিতরে, প্রত্যেক প্রাণীর ভিতরে, এ নানা প্রকৃতিতে খেলা করে। এর খেলাও রকমারি; খেলাগুলি দেখলে সহজে বোঝা যায় না। এসব সেই এক মনের খেলা। এই মন এক হয়ে রকমারি খেলবার জন্য অনেক হয়েছে।

৫৩

জন্ম জন্ম এর খেলা ফুরোয় না। একটা দেহে যত পারে খেলে; পরে সেই দেহটা নষ্ট হলে সে আপনার খেলার সামগ্রী লয়ে আবার অন্য একটা টাটকা দেহে ঢোকে। সেই দেহে ফের খেলা করে। মনের একটা ঘুমোবার শয্যা আছে। যতদিন না সেখানে গিয়ে ঘোর সুষুপ্তিতে ঘুমায়, ততদিন খেলার বিরাম নেই। বিছানায় একবার ঘুমুলে আর ওঠে না।

মনের একটা কোন বিশেষ চেহারা কি বিশেষ স্বভাব নেই। যে যে দেহে খেলা করে, সেই সেই দেহের চেহারায় মনের চেহারা, আর তাদের স্বভাবে মনের স্বভাব। এ-সকল দেখেশুনে জিনিসটা কি বুঝে নিতে হয়। মন শরীরের মধ্যে রয়েছে, আপন মনে খেলা করছে, কিন্তু যদি তাকে ধরতে যাও, কি দেখতে যাও, তাহলে অমনি লুকিয়েছে; ত্রিভুবন খুঁজলেও ধরতে কি দেখতে পাবে না। এই রকমে যে সে লুকোয় এও তার খেলা।

মন শরীরের মধ্যে সর্বব্যাপী হয়ে রয়েছে। কেমন তা জান? ঠিক যেন তিলের ভিতর তেল আছে; বলতে পার না যে, অমুক জায়গাটিতে নেই। মন যদি শরীর থেকে চলে যায়, কি শরীরের কোন অংশ থেকে চলে যায়, তাহলে শরীর কি শরীরের সেই অংশ জড় হয়ে যায়।

উইলসনের বাজিতে ঘোড়ার খেলা দেখেছ তো? মনের তেমনি ঘোড়ার খেলা আছে। ঘোড়ারা তার খুব বশ, যা বলে ঘোড়ারা তাই শোনে। এই মনটা যেন ঘোড়াদের প্রাণ। যখন ঘোড়ারা আস্তাবলে থাকে, তখন যেন মরা। আর যেমন মন তাদের পিঠে চড়ে লাগামটি ধরে, অমনি যেন উচ্চৈঃশ্রবা তড়িতের চেয়েও ছোটে। মনের ঘোড়া পাঁচটা, তাদের নাম কি জান? চোখ, কান, নাক, জিব আর ত্বক্। মন এদের পিঠে না চড়লে কেউ কোন কাজ করতে পারে না। চোখ দেখতে পায় না, কান শুনতে পায় না, নাক শুঁকতে

৫৪

পারে না, ত্বক্ অনুভব করতে পারে না। এই ঘোড়ার খেলা, মনের সিদে খেলা। মনের আরও বিস্তর খুব মারপ্যাঁচের খেলা আছে, তা কিছু কিছু বলি শোন।

সাগরে যেমন নানা রত্ন আছে, মন-সাগরেও তেমনি নানা জিনিস আছে। এ-সকল জিনিসের নাম বিষয়-জ্ঞান। ঘোড়ায় চড়ে যা কিছু দেখেশুনে শিখে সেসব বিষয়-জ্ঞান। মন বিষয়-জ্ঞান ভিতরে রেখে, সাগরের মতন এক বেশে থাকে। যখন যে জিনিস তার দরকার হয়, তখন নিজে ডুবুরী হয়ে, নিজের ভিতরে ডুব মেরে সেসব জিনিস তুলে আনে। ডুবুরীর কাজ যখন করে, তখন লোকে তার নাম দেয় স্মৃতি। আবার ঐ মন যখন ভালমন্দ, সদসৎ বিচার করবার জন্য দুটো হয়ে আপনা আপনি ঝগড়া করে শেষে মীমাংসা করে, তখন লোকে তার নাম দেয় বুদ্ধি। আবার যখন ঐ মন পোটো হয়ে বিষয়ের পটসকল আপনার ভিতর আঁকে, তখন লোকে তার নাম দেয় চিত্ত। আবার যখন 'আমি' 'আমি' বলে মেতে বেড়ায়, তখন মনের নাম অহঙ্কার।

মনের নানা রকম সাজ-বেশ আছে। তোমরা রঙ্গালয়ের লোক, বেশ জান যে একজন অভিনেতা রকম রকম পোশাক পরে দর্শকদের নানারকমের মূর্তি, প্রকৃতি দেখায়; মনও তেমনি নানারকম বেশ ধরে ও রকমারি খেলা দেখায়। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহাদির পোশাক পরে সে যেসব মূর্তি ও প্রকৃতি দেখায় সেসব পৈশাচিক মূর্তি ও প্রকৃতি। এসব মূর্তি ও প্রকৃতি ছেড়ে আবার যখন ঈশ্বর-আরাধনায় প্রবৃত্ত হয়, তখন দেবমূর্তি ধরে। মনের পৈশাচিক মূর্তি দেহীর পরম শত্রু, আর দেবমূর্তি পরম বন্ধু। মনের পৈশাচিক-বেশ মলিন-বেশ, ঐ বেশে জীবকে বদ্ধ করে! আর দেব-বেশ, শুদ্ধ বেশ, এই জীবকে মুক্ত করে। মলিন অবস্থাতে মনের স্বভাব কেমন থাকে জান? - ঠাকুর বলতেন, ঠিক কুকুরের লেজের মতো। এই

৫৫

টান, সোজা হলো আর ছেড়ে দাও তখনি কুণ্ডলী পাকিয়ে গেল। মনের দুটি অবস্থা - মলিন ও শুদ্ধ। মলিন অবস্থাতে মনকে বিশ্বাস করা যায় না। শুদ্ধ অবস্থায় যদি তাকে ঈশ্বরের পাদপদ্মে বেঁধে রেখে দেওয়া যায়, তাহলে ঠিক থাকে, নচেৎ সংসারে ছেড়ে দিলে আবার মলিন অবস্থায় (অপবিত্র অবস্থায়) গিয়ে পড়ে। ঠাকুর বলতেন, যেমন হাতির গা ধুইয়ে দিয়ে যদি হাতিশালে বেঁধে রাখা যায় তাহলে পরিষ্কার থাকে, নচেৎ ফাঁকে ছেড়ে দিলে আবার গায়ে ধূলা মেখে সে যেমনি ময়লা গা, তেমনি ময়লা গা করে ফেলে। শুদ্ধ অবস্থায় মনের আর মন নাম থাকে না, তখন তার নাম হয় চৈতন্য। চৈতন্য হলে যে চৈতন্যে জগৎ চৈতন্যময়, সে চৈতন্যময়ের সাক্ষাৎকার লাভ করে, তখন আর নিচে নেমে বদমাইশি করতে পারে না।

মনের একটা স্বভাব - তুমি তাকে যেখানে রাখবে, সে তখন তার মতো হয়ে থাকে। জড়ের সঙ্গে রাখ, জড় হয়ে থাকবে; চৈতন্যের সঙ্গে রাখ, চৈতন্য হয়ে থাকবে। যেমন অঙ্গারকে মাটিতে ফেলে রাখলে মাটির মতন হয়ে থাকবে, আবার আগুনের সঙ্গে রাখ, আগুন হয়ে থাকবে।

একটা তারে ঝঙ্কার দিলে যেমন তাতে নানা সুর বেরোয়, তেমনি মন আপনাতে আপনি ঘা দিয়ে নানা সুর গায়। প্রাণীর শরীর মনের বীণাযন্ত্র। শরীর চারি রকমের - স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ ও মহাকারণ। স্থূল শরীরে যখন মন খেলে, তখন কাম-কাঞ্চনের পেছু পেছু ঘুরে বেড়ায়; তখন কাম-কাঞ্চন ছাড়া যে আর কোন জিনিস আছে, তা তার আক্কেলেই থাকে না। সে তখন খালি জানে খেতে, ঘুমুতে আর ইন্দ্রিয়সেবা করতে।

যখন সূক্ষ্ম-শরীরে খেলে, তখন দেহীর গা গরম হয়। সে মনের খেলা তখন দেখতে পায়, সে তখন মনের সঙ্গে লড়াই

৫৬

করতে পারে। লড়াই করতে করতে কখনো হারে, কখনো জিতে। দেহীকে আপনাকে দেখিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে লড়াই করে মজা করে।

কারণ-শরীরে শিষ্ট শান্ত হয়ে থাকে, আর দেহীকে ঈশ্বর-দর্শনানন্দ ভোগ করায়। আর মহাকারণে নিজে ঘুমিয়ে জীবকে ঘুম পাড়ায়। এই ঘুমে আপনার রূপ, গুণ, বর্ণ হারায়, আর দেহীকে পরম শান্তির পদে তুলে দেয়।

এটি ভাল করে ভেঙে বলি শোন। সেতারে যেমন ষোলটা পর্দা আছে আর প্রতি পর্দায় ভিন্ন ভিন্ন সুর ওঠে, তেমনি দেহ-সেতারে সাতটি পর্দা আছে, এ পর্দায় পর্দায় মন নানা সুরে গেয়ে বেড়ায়। পরমহংসদেব বলতেন, প্রথমকার তিনটি পর্দাতে একটি ঘাট হয়েছে। মন যখন ঐ তিন পর্দায় বাজে, তখন দেহীকে একেবারে বেতালা করে। দেহীর লক্ষ্য কেবল আহার, নিদ্রা আর ইন্দ্রিয়সেবা। দেহী কাম-কাঞ্চনকে বুকের পাঁজর মনে করে বেহুঁশ হয়ে থাকে। মন যখন চতুর্থ পর্দায় ওঠে, তখন দেহীর ঘুম ভাঙা ভাঙা হয়। এই ঘুমুচ্ছে, এই ঘুম ভেঙে চমকে উঠছে। এখন সে জানতে পেরেছে যে, কাম-কাঞ্চন ছাড়া আরও মজার জিনিস আছে। এটি চেতনের ঘর। এ জায়গা থেকে দেহী ঈশ্বরের রাজ্যের আভাস পায়। সে আভাস প্রথম প্রথম মিটমিটে আভাস, ক্ষণস্থায়ী চঞ্চল বিদ্যুতের মতো। এখন আর বেহুঁশ হয়ে ঘুমাবার জো নেই। এ অবস্থায় কিছুদিন গেলে, তার গা-টি আরও কিছু গরম হয়। আগে যে ঈশ্বররাজ্যের আভাসটি মিটমিটে ছিল, এখন সেটি আলোর মতো, কিন্তু চঞ্চলতা ও স্থায়িত্বের সম্বন্ধে বড় ইতরবিশেষ হয় না; সেজন্য ভগবানের কথায় একাগ্রমন হয়ে থাকতে পারে না; ভ্যানভেনে মাছির মতো ময়রার সন্দেশের থালাতেও বসে, আবার মেথরের ময়লার ভাঁড়েও বসে। পঞ্চম ঘরে মন উঠলে দেহীর পূর্বস্বভাব প্রায় বদলে যায়। এখন তাকে দেখলে আর আগেকার মানুষ বলে চেনা যায় না।

৫৭

এখন আর সে কাম-কাঞ্চন নিয়ে ঘুমুতে চায় না। মাতালের যেমন মদ্যপানে রোক্, এর তেমনি ঈশ্বরীয় কথাশ্রবণ-কীর্তনে রোক্। এখন তার মন মনের মতন। এখন সে অবিদ্যার কুরূপ দেখতে পেয়েছে, মনের খেলার দৌড় বুঝেছে, মনের সঙ্গে লড়াই করতে শিখেছে, মনকে পেছু পেছু ছুটাতে পেরেছে, মনের ভিরকুটি ধরতে পেরেছে, মনের পুতুলবাজির খেলার হদিস পেয়েছে। ষষ্ঠ ঘরে যখন ওঠে, দেহী তখন ঈশ্বরদর্শন করতে পায়, কিন্তু ঈশ্বরকে ছুঁতে পারে না। ঠাকুর বলতেন, যেমন একটা লণ্ঠনের ভিতরের প্রজ্বলিত দীপশিখা লণ্ঠনের বাহির থেকে দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু ছুঁতে গেলে লণ্ঠনের কাঁচে বাধা লাগে, তেমনি দেহী এই জায়গায় বসে ঈশ্বরকে দেখতে পায়, কিন্তু ছুঁতে পারে না, একটা আবরণে আটক রাখে। এ অবস্থা দেহীর দুর্লভ অবস্থা। ঠাকুর বলতেন, পাঁচের ঘরে আর ছয়ের ঘরে বাচ খেলে বেড়ানো ভারি মজা।

বাচ খেলে বেড়ানো কি জান? - গঙ্গায় পানসী নিয়ে তকরার করে ঘোড়দৌড়ের মতো খেলা করা দেখেছ তো? একবার এধারে আসে, একবার ওধারে যায়, তাকে বাচ খেলা বলে। এখানে মনের বাচ খেলা একবার ছয়ের ঘরে, একবার পাঁচের ঘরে, অর্থাৎ একবার ঈশ্বরকে দর্শন করে, আবার নিচে পাঁচের ঘরে নেমে সেই দর্শন কীর্তন করে। এর নিচে অর্থাৎ চতুর্থ ঘাটে মজা আদতেই নেই। কেন না অনেক সময়ে অবিদ্যামায়া তাঁর শক্তিতে আচ্ছন্ন রাখেন! আবার এর ওপর ঘরে অর্থাৎ সাতের ঘরে মন উঠলে, দেহীর ভোগ কি আস্বাদ করার শক্তি থাকে না। এখানে মন মনহারা হয়, আর দেহীর সমাধি হয়। একেই বলে মনের লয়। লয় কেমন জান? এক ফোঁটা গঙ্গাজল নিজের রূপ গুণ হারিয়ে গঙ্গার জলে মিশে গেল। মনরূপ নুনের পুতুল গঙ্গাজলে গলে গেল, এত দিনে মনের খেলা ফুরুলো।

৫৮

পা। আপনি তো মূর্খ লোক, কোন শাস্ত্র পড়েননি, সকলে বলেও তাই, তবে আপনি এত জানলেন কি করে?

ভ। আমি তো তোমাকে পূর্বে বলেছি, রামকৃষ্ণদেবকে দর্শন করলে সব দর্শন হয়, যাবতীয় অবতারের দর্শন হয়। তাঁকে বুঝলে সব শাস্ত্রের নিগূঢ় তত্ত্ব বুঝা যায়, সাধন-ভজনের ফল মানুষ অনায়াসে পায়। তাঁর দর্শনের এমন গুণ যে, একটা বেহুঁশ বদ্ধ জীবের হুঁশ আসে, ঘুমন্ত মানুষ জেগে ওঠে, মূর্খ মানুষ পণ্ডিত হয়, কানার চোখ ফোটে, কালা শুনতে পায়, খোঁড়া সাগর ডিঙোয়, বোবা বক্তা হয়। তাঁর শ্রীবাক্যগুলি মহামন্ত্র, সেসব বাক্যের বিষম জোর। যেখানে পড়ে, সে হাজার আঁধার স্থান হোক না কেন, অমনি আলোময় হয়। ঠাকুর বলতেন, চিরকেলে আঁধার ঘরে যদি একবার একটা দেশলায়ের কাটি জ্বালা যায়, তাহলে চকিতে যেমন গোটা ঘরটি আলোময় হয়, তেমনি ঈশ্বরের বাক্য ও তাঁর কৃপা পড়লেই মানুষের চিরকেলে আঁধার কুটির নিমেষে আলোময় হয়।

বারুদ আর আগুনের জোরে যেমন ছোট সীসার গোলা কামানের মুখ দিয়ে বেরিয়ে একটা পাহাড়কে চুরমার করে দেয়, তেমনি ঠাকুরের কথার ভিতর এমনি শক্তি যে, নিগূঢ় মায়ার আবরণ, যাতে ঈশ্বরকে ও ঈশ্বরের তত্ত্বসকলকে আবরণ দিয়ে রেখেছে, সে আবরণকে একেবারে চূর্ণ করে ফেলে। ঠাকুরের শ্রীবাক্যগুলি গোলার মতন শক্তিধর।

ঠাকুরের শ্রীবাক্যের আর একটা মহিমা বলি শোন। লোকে যে কথা কয়, সে যেমন হাওয়ার কথা - হাওয়ায় খোলে, হাওয়ায় দোলে, হাওয়ায় মিশায়, ঠাকুরের কথাগুলি তেমন নয়; কথাগুলি যেমন বেরুল, তেমনি কানের ভিতর দিয়ে ঢুকে হৃদয়ে পড়ল। যেমনি হৃদয়ে পৌঁছে গেল, অমনি কথিত বিষয়ের একটি প্রতিচ্ছবি হৃদয়ে উঠে পড়ল, সে কেমন জান? যেমন এদিকে ক্যামেরার কলটিও

৫৯

টেপা, আর ওদিকে ছবিটিও ওঠা। যার অন্তরে ছবিটি উঠল, সে ঠাকুরের কথাটি শুনে আর ছবিটি দেখে বিষয়টি একেবারে বুঝে নিলে, দেখে নিলে, আবার চিরকালের মতো সঞ্চয় করে রাখলে। আর লোকে যে কথা কয়, সে হাওয়ার কথা, এ কান দিয়ে ঢুকল আর ও কান দিয়ে বেরুল; কিছু তার একটা চিহ্ন থাকে না। যেমন যখন জলে জাহাজ চলে যায়, তখনি জলে একটা দাগ পড়ে, তার পরেই সব মিলিয়ে যায়, এত বড় জাহাজটা জলটাকে দুখানা করে দিয়ে গেল, তার কোন চিহ্নই রইল না; তেমনি মানুষের কথা, বলবার সময় খুব ধুমধাম কিন্তু একটা চিহ্ন রাখতে পারে না, মানুষের অন্তরে ঢুকে না, যদি ঢুকে তো ঠাঁই পায় না। ছেলেরা জলে খোলামকুচি নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, খোলামগুলো জলের উপর দিয়ে তরতর করে লাফিয়ে চলে যায়, জলের ভিতরে আর যায় না।

ঠাকুরের কথার আর একটা মহিমা বলি শোন। ঐ যে অন্তরে কথার প্রতিমূর্তি উঠল, ঐ ছবি জীবন্ত হয়। জীবন্ত হয়ে বীণাবিনিন্দিত কণ্ঠে রামকৃষ্ণদেবের মহিমা গীত গায়, অতি মধুর গীত; শুনলে দাবানল জল হয়। কখন গায় জান? - যখন তুমি শোকাকুল হয়ে পড়েছ, যখন তোমার অন্তরে অবিদ্যা-মায়া আগুন জ্বালাবার চেষ্টা পাচ্ছে, সেই মুশকিলের সময়। আর কি করে জান? যদি চোর ডাকাতে ধরতে আসে, তাহলে পরম বন্ধুর মতো অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে তুমি না ডাকতে ডাকতে আপনি বেরিয়ে এসে এমন তর্জন গর্জন করে যে, ভয়ে দস্যুরা কোন দিকে পালাবে, তার পথ পায় না। অবিদ্যার বাজারে চোর-ডাকাতের তো অভাব নেই। কেবল চোর-ডাকাতেরই রাজ্য। আনাচে কানাচে চারদিকে উঁকি মারছে, এমন সহায় না থাকলে কি আর রক্ষা আছে? এ চোর-ডাকাত

৬০

কারা জান? - কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য আর তাদের ছানাপোনা!

রামকৃষ্ণদেবকে দর্শন করলে, তাঁর কৃপা পেলে গুপ্ত ভগবান ব্যক্ত হন; দূরের ঈশ্বর কাছে হন; সেই ঈশ্বর এই ঈশ্বর হন; তিনি ঈশ্বর ইনি ঈশ্বর হন আর দেবদেবীদিগকে ঘরের লোক বলে মনে হয়। এখন বুঝ, রামকৃষ্ণ কি! তোমরা রামকৃষ্ণকে দর্শন করেছ, তাঁর শরণাপন্ন হয়েছ, তোমরাও ক্রমে বুঝতে পারবে।

পা। আপনি মনের কথা বলছিলেন। মন এমন শক্তিধর! মনকেই যে সর্বেসর্বা দেখছি। মনের উপর রামকৃষ্ণদেবের কোন আধিপত্য নেই?

ভ। মন সর্বেসর্বা নয়; সর্বেসর্বা রামকৃষ্ণদেব। জ্ঞানেন্দ্রিয়দের মুখে লাগাম দিয়ে মন যেমন তাদের উপর চড়ে বেড়ায় তেমনি রামকৃষ্ণ মনের মুখে লাগাম দিয়ে তার পিঠে চড়ে বেড়ান। রামকৃষ্ণ মনকে যা বলেন, সে তাই করে। মন যে এত লাফিয়ে বেড়ায়, নেচে কুঁদে বেড়ায়, গরম হয়ে বেড়ায়, নানা বুজরুকি করে বেড়ায়, সে খালি রামকৃষ্ণদেবের ইচ্ছায়, সে রামকৃষ্ণের জোরে; সে কেমন তা জান? হাঁড়িতে জল, চাল, ডাল দিয়ে জ্বাল দিলে কিছুক্ষণ পরে চালডালগুলো লাফাতে থাকে! তারা যে লাফায়, সে তাদের বলে নয়, সে আগুনের বলে; সে রকম শরীর-হাঁড়ির ভিতরে মন-বুদ্ধি যে লাফিয়ে বেড়ায় সে তাদের বলে নয়, সে রামকৃষ্ণদেবের শক্তিবলে। এ উপমাটি ঠাকুরেরই উপমা।

পা। রামকৃষ্ণ যখন এ উপমাটি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তখন তিনি কি বলেছিলেন, জীবের শরীরে মন-বুদ্ধি তাঁর জোরে লাফিয়ে বেড়ায় - না মা-কালীর শক্তিতে লাফিয়ে বেড়ায়? তিনি তো কালী বই আর কিছু জানতেন না।

ভ। তিনি বলেছিলেন, মা-কালীর জোরে লাফিয়ে বেড়ায়।

৬১

যীশু নিজেই সেই পিতা হয়ে যেমন সকল বিষয়ে পিতার শক্তি, পিতার ইচ্ছা, পিতার মহিমা, পিতার দোহাই দিতেন, তেমনি রামকৃষ্ণদেব নিজে সেই মা হয়ে সেই রাম হয়ে সেই কৃষ্ণ হয়ে মায়ের শক্তি, মায়ের ইচ্ছা, মায়ের মহিমা বলতেন; আবার কৃষ্ণের ইচ্ছা কৃষ্ণের শক্তি বলতেন বা কখনো কখনো রামের শক্তি, রামের ইচ্ছা বলতেন। তিনি অন্য নামের দোহাই দিয়ে বলতেন বটে, কিন্তু আমাকে দেখিয়েছেন যে, তিনিই তাই। আমি কালীও জানি না, রামও জানি না, আর কৃষ্ণকেও জানি না। আমি জানি রামকৃষ্ণকে। আবার রামকৃষ্ণকে ধরে কালীকেও জানি, রামকেও জানি, কৃষ্ণকেও জানি।

আমার রামকৃষ্ণদেব ভিন্ন অন্য কোন বোধ নেই। এক সময় তাঁকে বিগ্রহরূপে দেখেছিলাম, এখন তাঁকে বিরাটরূপে দেখছি। এই জীব-জগতে তাঁকেই দেখতে পাচ্ছি। তুমি তো বেশ জানো, আমি মূর্খ - রামায়ণ মহাভারতও পড়িনি, কোন সাধনও করিনি, কোন একটা কর্মও করিনি। আমার সম্বল রামকৃষ্ণদেব। তুমি ঈশ্বরের যে নামই বল না কেন, আমি সেই নামটির ভিতরে রামকৃষ্ণকেই দেখতে পাই, সুতরাং রামকৃষ্ণ ও তাঁর শক্তি ভিন্ন আর কি বলব?

পা। মনের ভিরকুটি না ভাঙলে যখন কোন কাজই হবে না, তখন মনকে বুঝা যায়ই বা কি করে আর মনকে ধরাই বা যায় কি করে? মনটাকে জানবার জন্য আমার বড় ইচ্ছা হচ্ছে।

ভ। রামকৃষ্ণদেবের মহিমা দেখ; রামকৃষ্ণদেবের দর্শনলাভের মহিমা দেখ; রামকৃষ্ণদেবের লীলা-শ্রবণ-কীর্তনের মাহাত্ম্য দেখ! সাক্ষাৎ মহিমা, মূর্তিমান মহিমা!

এ লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে কত শত নানাশাস্ত্রবিশারদ উচ্চ উচ্চ উপাধিধারী পণ্ডিত রয়েছেন, কত শত রাজভাষাভিজ্ঞ, নীতিজ্ঞ, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতি উচ্চ উচ্চ পদাভিষিক্ত মহামান্য ব্যক্তি রয়েছেন,

৬২

কত শত কুবেরসম অতুল-ধনসম্পত্তিশালী ধনাঢ্য রয়েছেন, কত শত নমস্য নানাবেশধারী ধর্মজ্ঞ রয়েছেন, কিন্তু তুমি যে থিয়েটারের লোক হয়ে উচ্চ ঈশ্বরীয় তত্ত্ব বুঝবার ও জানবার জন্য - ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছ ও দেখাচ্ছ, এ ব্যাকুলতাটি এতাবৎ লক্ষ লক্ষ লোকের মধ্যে ক-জনার হয়েছে? তুমি মহা ভাগ্যবান, তুমি ধন্য ও রামকৃষ্ণদেবের মহিমা-ধন্য! রামকৃষ্ণ প্রভুর যে কৃপার বলে হঠাৎ তোমার মনে এতাদৃশ গুরুতর তত্ত্বের উদয় হয়েছে, সে বলই তোমাকে মনের বিষয় বুঝিয়ে ও জানিয়ে দেবে! রামকৃষ্ণদেব পরম দয়াল। তাঁর শরণাপন্ন হলে তিনি মনের ভিরকুটি ভেঙে দেন। তুমি কেবল তাঁকে ধরে বসে থাক।

পা। তাঁকে ধরে বসে থাকা কেমন?

ভ। ঠাকুরের মূর্তিটি স্মরণ কর, ভক্তি-বিশ্বাসের জন্য প্রার্থনা কর, আর তাঁর লীলাগুণ কীর্তন কর ও শ্রবণ কর।

পা। এ করলেই হবে? আর কিছু করতে হবে না? শুনেছি কত সাধন-ভজন করলে তবে কিছু হয়।

ভ। ভাই! এখনো তুমি রামকৃষ্ণ-দর্শনের ফল কিছুই বুঝতে পারনি। রামকৃষ্ণলীলাকথার আন্দোলন যে কি উচ্চ সাধন-ভজন, তা তুমি এখনো জানতে পারনি। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের শ্রীমূর্তি ফুল দিয়ে, গোড়ের মালা দিয়ে তোমরা যে সাজাও তার চেয়ে উচ্চ সাধনা আমি আর কিছু জানি না। সাধন-ভজন বিনে কিছু হয় না, তা আমি জানি, আর রামকৃষ্ণদেবও কিছু সাধন-ভজন না করিয়ে ছাড়েন না। তবে রামকৃষ্ণদেব যে সাধন করিয়ে নেন, সে বড় মজার সাধনা। সে সাধনায় মানুষের আয়াস লাগে না, বড় স্ফূর্তি আছে, আনন্দ আছে। সে কেমন জান? যেমন একজন লোকের বৃন্দাবন যাবার সাধ হয়েছে, রাধাকৃষ্ণদর্শনের বড় সাধ হয়েছে, তার পাথেয় নেই, চলে যাবার শক্তিও নেই, আছে কেবল সাধটি। এখন সে

৬৩

ঘুরতে ঘুরতে ঘটনাক্রমে একটি সম্বলওয়ালা লোকের কাছে এসে পড়ল। তিনি তাঁর সাধটির কথা শুনে বললেন - আয়, আমার সঙ্গে আয়। সঙ্গে করে হাওড়া স্টেশনে নিয়ে গিয়ে একখানি বৃন্দাবনের টিকিট কিনে দিলেন, পথে যা খাবে তাও একটি হাঁড়িতে করে যোগাড় করে দিলেন, আবার একটা বিছানারও যোগাড় করে দিলেন, আর বললেন - যা, তুই এবার বৃন্দাবনে যা। রামকৃষ্ণদেব এমনি করে সম্বল দিয়ে ইষ্ট-দর্শনে পাঠিয়ে দেন। রামকৃষ্ণদেবের কৃপায় এমন অঘটন উপায় জুটে পড়ে।

ঠাকুর বলতেন, সরকারি বাতাস বইলে আর পাখার বাতাস দরকার হয় না। এখন সরকারি বাতাস চলছে, সাধন-ভজনরূপ পাখার বাতাস আবশ্যক নেই। সরকারি বাতাসটি কি, বুঝেছ? সেটি রামকৃষ্ণদেবের কৃপা। তিনি বলেছেন - আমি এখন সশরীরে; এখন কর্মের আবশ্যক নেই। অনায়াসে পাকা ফসল পাবি। একদিন হরিশ (ঠাকুরের একটি সেবক) পঞ্চবটীর তলে ধ্যান করছেন, ঠাকুর এখানে শ্রীমন্দির থেকে জানতে পেরেছেন। তখনই সেখানে হাজির; হরিশের বুকে হাত দিয়ে ধ্যান ভাঙিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, "ওরে, কার ধ্যান কচ্ছিস? আয়, আমার সঙ্গে আয়, পাকা আম খাবি।"

এখন বল দেখি, কোন্ কালে জীবকে এমন সাহস, এমন আশা কে কখনো দিয়েছেন! কেবল এই ঠাকুর দেখছি। যে গুরু হেলায় একটা জীবকে ইষ্টদর্শন করান, তাঁর মহিমা আমি কি বলব! তাঁর কথা বলতে গেলে ঠোঁটে ঠোঁটে যোড় লেগে যায়।

প্রতাপ হাজরা ঠাকুরের কাছে ঐ কালীবাড়িতে থাকতেন। হাজরা একজন মহাতপস্বী, তপ জপ খুব ভালবাসেন, মালা ধরে জপ করা তাঁর যেন প্রাণ ছিল। হরদম জপ চলছে। ঠাকুর কতবার তাঁর হাত থেকে মালা ছিনিয়ে নিতেন, মালা জপ করতে কত বাধা দিতেন, আর বলতেন - এখানে এসেছ, মায়ের ইচ্ছায় সব

৬৪

আপনি হবে, তিন টুসকিতে কাজ হবে। এত মেহনত কেন? হাজরা কিন্তু সে কথায় বিশ্বাস করতেন না। তিনি ঠাকুরের কাছে মালাটি চেয়ে নিয়ে আবার জপে বসতেন। হাজরা ঠাকুরের কাছে বহুকাল থেকে জুটেছেন। যখন ঠাকুর দেশে শিহড়ে হৃদয়ের বাড়িতে মধ্যে মধ্যে গিয়ে ৩।৪ মাস ক্রমান্বয়ে থাকতেন সে সময় থেকে হাজরা জুটেছেন। হাজরা রামকৃষ্ণলীলায় একটি বড় মজার জিনিস। ঠাকুর হাজরার সঙ্গে খেলা করে অবিশ্বাসী জীবকে ভূরি ভূরি জ্বলন্ত শিক্ষা দিয়েছেন আর নিজের ভক্তদের একটা রঙ দেখিয়েছেন; তিনি এটা আর বিশ্বাস করতে পারলেন না যে, ঠাকুরের কৃপায় মানুষ বিনা চাষে ঘরে বসে ষোল আনা ফসল পায়। হাজরার সঙ্গে ঠাকুরের খেলাটি শুনলে অতি সহজে বিস্তর রামকৃষ্ণ-মহিমা দেখা যায়, দেখলে অতি বড় অবিশ্বাসী হৃদয়েও ঠাকুরের পাদপদ্মে অটল বিশ্বাস জন্মে; বেদবাক্য অপেক্ষা গুরুবাক্যের গুরুত্ব গভীরত্ব ও সদাফলদায়িনী শক্তি প্রত্যক্ষ করে, আর একটি বিশেষ কথা - ঠাকুরের শরণাপন্ন হলে যে হেলায় ঈশ্বরলাভ হয়, এ বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহ থাকে না।

কর্মে - সাধন-ভজনে যাঁদের বাসনা থাকত, ঠাকুর তাঁদের বাসনা পূরণের জন্য কাকেও বলতেন - তুমি মা-কালীর ঘরে তিন দিন কিছু জপ করো; কাকেও বলতেন - যদি তিন দিন না পার, এক দিন করো; কাকেও বলতেন - তুমি যদি অন্য জপ-ধ্যান করতে না পার, এখানের - (অর্থাৎ ঠাকুরের) স্মরণ-মনন রেখো; কাকেও বলতেন - তোমার কিছু করতে হবে না; এখানে এলে গেলেই হবে - এই আজ এসেছ, আর দুদিন এস; কাকেও বলতেন - তুমি এক দিন মঙ্গলবারে কি শনিবারে এস তাহলেই হবে। কখনো কখনো ভাবাবেশে বলতেন, এখানে এসে সরল প্রাণে যে বলবে, 'হে ঈশ্বর, তোমার তত্ত্ব বা তোমাকে কি করে জানব!' সে নিশ্চয় তাঁর তত্ত্ব পাবে

৬৫

পাবে পাবে। শ্রীমুখে একবার বললেই যথেষ্ট, তবে যে তিনি তিনবার বললেন, এর মানে - এখনকার জীব একেবারে বিশ্বাসহারা, ভক্তিছাড়া, অবিদ্যার রূপে মরা, বিষয়বিষে জর্জরিত; তবু যদি বিশ্বাস করে, তাই তিনি তিনবার বললেন। ঠাকুর বলতেন, কলির জীবকে ষোল টাং বললে যদি এক টাং নেয়। তাই শিক্ষায় ও কর্মে ঠাকুর ষোল টাং দেখালেন।

যে ঠাকুরের এই কথা, বুঝ দেখি তাঁর দয়া-করুণার কি আর সীমা আছে? এতেও মানুষ ঠাকুরকে নিলে না, ঠাকুরের কথায় কান দিলে না। এদের নাম জীব, এদের নাম মানুষ। হে রামকৃষ্ণদেব! আর যা দাও দিও; যেখানে রাখতে হয় রেখো, কিন্তু ঠাকুর! দোহাই তোমার, মানুষের মতো বুদ্ধিটি দিও না, আর এমন মানুষের সঙ্গে রেখো না। এই তো মানুষ সামান্য ধন, মান, যশ, পদের জন্য লালায়িত, কিন্তু ভগবান, তুমি কোথায় বা তোমাকে কি করে পাব, একথা কেউ বলে না। এই তো মানুষের বুদ্ধি - কাঞ্চন ফেলে কাঁচের আদর করে; মণির হার ফেলে কালকূটভরা ফণীকে কণ্ঠে পরে। জীবের কথায় প্রাণ শিউরে ওঠে। ভাই, প্রাণভরে বল, 'জয় রামকৃষ্ণদেবের জয়।'

শোন, প্রাণ-জুড়ানো ঠাকুরের কথা শোন। ঠাকুরের ভাণ্ডার কেমন শোন, ঠাকুর দয়াল কত শোন, ঠাকুরের আশা-ভরসা দেওয়া কত শোন; ঠাকুরের মহিমা শোন; ভাবাবেশে একদিন বলছেন - ওরে, যে একবার এসে একটা নমস্কার করবে; তার আর ভয় কি? ওরে, যে শরণাপন্ন হবে, তাকে কিছু করতে হবে না। আমি অনেক দিন কঠোর তপস্যা, সাধন-ভজন করে আমার ভিতরে একটা ছাঁচ তৈরি করে রেখেছি; ঐ ছাঁচে ফেলে দিব, অমনি গড়ন হয়ে যাবে; এ ছাঁচটার সঙ্গে টাঁকশালের কলের উপমা। টাঁকশালে এদিকে রূপার ডেলাটা ফেলে দিলে তখনই ওদিকে রানীর মুখ সহিত ঝকমকে

৬৬

টাকা হয়ে বেরিয়ে যায়। ঠাকুরের ছাঁচটিও তেমনি। বুঝ ভাই - কি ঠাকুর! কেমন ঠাকুর! আর কোথাকার ঠাকুর! এখন চেয়ে দেখ - কি ঠাকুর দর্শন করেছ, কার মহাপ্রসাদ খেয়েছ! আর সাধনার কি বাকি রেখেছ! ভগবান-দর্শনের জন্য পূর্বজন্মে কতবার মাথা কেটে আহুতি দিয়েছিলে, সেই ফলে এ ঠাকুরের দর্শন পেয়েছ। অবিদ্যার নেশায় অনেক দিন ঘুরেছ; তাঁর দর্শনে নেশা গেছে, কেবল ঘোরটা কিছু আছে; ঠাকুরের লীলাকথা আন্দোলন কর, মনের সাধে ঠাকুরের প্রতিমূর্তি ফুল দিয়ে সাজাও, মনের মতন ভোগ দাও, আর বগল বাজিয়ে নাচো। আর বল - জয় রামকৃষ্ণদেবের জয়। এখন তোমরা মুক্ত-পুরুষ।

পা। মুক্ত হলেম কি করে? যেমন ছিলাম, তেমনি রয়েছি - সেই রোগ, শোক, সংসারে খাটুনি; সেসব রয়েছে, আর ঘুরে বেড়াচ্ছি।

ভ। পূর্বের নেশার ঘোর আছে - তাই এ-রকম দেখাচ্ছে। সেটা কেমন জান? তুমি একটা খুব বলবান ঘোড়ায় চড়েছ, ঘোড়াটা খুব দৌড়াচ্ছে; এমন সময় মনে করলে যে, আমি অমুক জায়গায় একে থামাব; তার মতো তুমি দূর থেকে লাগাম টেনে আসছ; ঘোড়াটাও থেমে থেমে আসছে বটে; কিন্তু যেখানে থামাব বলে মনে করেছিলে, সেখানে থামি থামি করেও আর দশ হাত এগিয়ে পড়ে। তোমারও তাই ঘটেছে, দশ হাতের ভিতরে আছ, কিন্তু থেমে গেছে। এটুকু গেলেই মুক্ত বলে জানতে পারবে।

আর ঐ যে বললে, যেমন সংসারের খাটুনি, তেমনি রয়েছে। এর উত্তরে ঠাকুরের কথা শোন। তিনি বলতেন, কেরানী জেল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এলে সে কেরানীগিরিই করবে - না ধেই ধেই করে নেচে বেড়াবে? সংসারী লোক ভগবানের কৃপায় মুক্ত হলে সংসারেই থাকে। সংসার কি ভগবান ছাড়া? তাঁরই সংসার।

আর রোগ-শোকের বিষয় - উনুনশালে থাকলেই গায়ে আঁচ লাগে।

৬৭

সংসার জ্বলন্ত চুলো, সেখানে বসতবাড়ি। গায়ে তাপ লাগবে না? গায়ে দাগ লাগবে না? এসব সত্ত্বেও জীব ঈশ্বরকৃপায় মুক্ত হয়। নিজের অবস্থা নিজে বুঝবে।

পা। মুক্ত হয়েও ঘুরচি, ঐ যে ঘোড়ার উপমা দিয়ে বললেন, ওটা বুঝা গেল না; ওটা কি রকমের?

ভ। ওটা কি রকমের, অন্য কথায় শোন। একজন (হাঁড়ি-গড়া) কুমোর একটা লাঠি দিয়ে তার চাকাখানা বনবনিয়ে ঘুরিয়ে দেয়। লাঠি দিয়ে যতক্ষণ ঘুরাচ্ছিল, ততক্ষণ খুবই ঘুরছিল; এখন লাঠিটা ছেড়ে দিয়েছে, তবু চাকা ঘুরছে। তোমার চাকাতে এত দিন লাঠি ছিল, কিন্তু যেই তাঁকে দর্শন করে ফেলেছ, অমনি লাঠি তুলে নিয়েছেন, তবে এখনও যে ঘুরছ, সে পূর্বেকার পাকের দরুন। এ ঘুরুনিতে অনেক কাজ আছে। ঠাকুর এ-সময়ে আর এক রকমের কতকগুলি বাসন গড়বেন। পরে দেখতে পাবে।

পা। ঘুরুনিটা কখন বন্ধ হবে? আর হচ্ছে কিনা, কি করে জানতে পারব?

ভ। রামকৃষ্ণদেব নিজের ভিতরে তোমার মনটা যত টেনে নিবেন তত ঐ ঘুরুনি কমতে থাকবে। যখন সব মনখানা টেনে নিবেন তখন একটা ভারি মজা দেখতে পাবে। এই সংসারের হাঙ্গামা-শোক, রোগ, ভয় ইত্যাদি এগুলি থেকেও থাকবে না; এটাই শান্তির অবস্থা।

থেকেও নেই - এখন তোমাকে সেটা বুঝাতে পারব না। এ অবস্থার কথা, যখন হবে তখন বুঝবে। তোমার মনই তোমাকে দেখিয়ে দেবে, তোমাকে বুঝিয়ে দেবে। এখন তোমার মন বলছে, বাঁধা রয়েছি, মুক্ত কি করে হলুম? তখন বলবে, আমার আবার বাঁধন কিসের? আমি তো চিরকালই মুক্ত। সেজন্য ঠাকুর বলতেন - মানুষ

৬৮

মনে বদ্ধ, মনে মুক্ত। হাজার কাজ থাকলেও মুক্ত-পুরুষ বদ্ধ হন না।

পা। যে মন বেঁধে রেখেছে, সেই মনই বাঁধন খুলে দেয়! তাহলে মনটাকেই যে সর্বেসর্বা দেখছি। কিন্তু আপনি পূর্বে বললেন রামকৃষ্ণদেব মনের রাজা।

ভ। তুমি প্রভুর কৃপায় খুব লীলা দেখতে ও বুঝতে পারছ। এখন শোন, মনে আর ঠাকুরে প্রভেদ কি! তোমাকে পূর্বে ভগবানের স্বরাট্ ও বিরাট মূর্তির ও খেলার কথা বলেছি। বাহ্য-জগৎ ও অন্তর্জগৎ নিয়ে যে খেলা, তার কথাও যথাসাধ্য বলেছি। এ অন্তর্জগতের খেলা। একটি কথা বিশেষ করে মনে রেখো - এ সৃষ্টিতে কেবল সেই একের খেলা। এক মানে রামকৃষ্ণদেব। রামকৃষ্ণদেব বই আর দোসরা জিনিস নেই। লীলাতে এ এক - মূল জিনিসটি অগণ্য কোটি রকমে পরিণত হয়েছেন। যেখানে এক, সেখানে আর কথা নেই। যেখানে লীলা অর্থাৎ অনন্ত কোটি, সেখানেই কথা। লীলাকথার প্রসঙ্গে আত্মা, পরমাত্মা, ভগবান, শক্তি, মায়া, মন, বুদ্ধি ইত্যাদি যা কিছু আমি বলি না কেন, তুমি বুঝে নিও এ রামকৃষ্ণদেব বই আর অন্য কিছু নয়। অবস্থা-ভেদে, রূপ-ভেদে, আকার-ভেদে, গুণ-ভেদে, নাম-ভেদে ও বৃত্তি-ভেদে এ একটি জিনিস লীলাতে অনন্ত রকমে অনন্ত হয়েছেন; সুতরাং লীলাকথায় এ এক জিনিসকে নানা নামে বলতে হয়। এ দুনিয়ায় কেবল একেরই রকমারি - সেটি কেন জান? মোটামুটি উপমাতে যেমন একটা কাঠের কারখানা। কারখানাতে মূল উপাদান কেবল এক - কাঠ। এ এক কাঠে নানা জিনিস হয়েছে, যথা - বিম, তক্তা, দরজা, আলমারি, খাট, সিন্দুক, বাক্স, কৌটা, জাহাজ, খেলনা ইত্যাদি ইত্যাদি। যেখানে শুধু কাঠ, সেখানে আর রকমারি নেই, সুতরাং কথাও নেই, কথার মধ্যে ঐ এক কথা - কাঠ। যেখানে কারখানা সেখানে রকমারি ও তাদের

৬৯

নানা নাম হেতু নানা কথা। কারখানাতে কাঠের জিনিসগুলি আকারে, বর্ণে, অবস্থায়, বৃত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন দেখায় বটে, কিন্তু সকলের ভিতরেই সেই এক-কাঠ বা সেই এক-কাঠে তৈরি। এক-কাঠ কারখানাতে নানা রকমারিতে পরিণত হওয়া হেতু যেমন সে এক-কাঠেরই নানা নাম হয়েছে, তেমনি এ এক-রামকৃষ্ণদেব তাঁর লীলা-কারখানাতে স্থূল সূক্ষ্ম নানা ভাবে নানা রূপে পরিণত হওয়া হেতু এ এক-রামকৃষ্ণদেবেরই নানা নাম হয়েছে। সৃষ্টিতে সকলের মধ্যেই এ এক-রামকৃষ্ণদেব বা সকলই এ এক-রামকৃষ্ণ উপাদানে গঠিত।

এখানে একটা গান শোন:

হরে রামকৃষ্ণ বল রামকৃষ্ণ বল মন।
রামকৃষ্ণ আমার ভুবনচন্দ্র আলো করেছেন ভুবন॥
যেই রাম যেই কৃষ্ণ, তিনি এই রামকৃষ্ণ, বিশ্বগুরু জগতের ইষ্ট,
আমি দেখেছি পড়েছি স্পষ্ট শ্রীঅঙ্গে আছে লিখন॥
পেলে পরে দেখবি তাঁরে, সাকারে সে নিরাকারে,
আত্মারূপে সবার ভিতরে, সে চেতনে সেই জড়ে, কারণের মহাকারণ॥
কে রামকৃষ্ণ কোথাকারে, কাজ কি রে তোর সে বিচারে,
তোর বিন্দু-আধার তায় সিন্ধু কি ধরে,
তুই যাবি যদি ভবপারে ভজে নে অভয় চরণ॥

এক পরমাত্মা - তিনি বিরাটে বাহিরে বহুধা হয়েছেন। এ বহুধা এক রকমের নয়, আকারে বরণে গুণে ও প্রকৃতিতে এমনভাবে তিনি অনন্ত হয়েছেন কার সাধ্য বুঝে যে, সেই এক জিনিস ও একের খেলা। এ এক-জিনিসটিকেই আমরা নানা নামে ডাকি। তিনিই পরমাত্মা, তিনিই জীবাত্মা, তিনিই মন ইত্যাদি। তিনিই কখনো ঘোড়া ও কখনো সওয়ার। তোমাদের রঙ্গালয়ে দক্ষযজ্ঞে ভূত সাজে জান তো? যারা সাজে তারা মানুষ, গায়ে মুখে হাতে কালি মেখে ভূত হয়, তেমনি আত্মা গায়ে ময়লা মেখে মন হয়ে মনের খেলা

৭০

খেলে। আবার ঐ জিনিসই কতকগুলি উপাধি নিয়ে জীবাত্মা হয়ে থাকে। এ-সকল খেলা সব রামকৃষ্ণদেবের গুপ্ত-খেলা। তিনি না দেখালে কারো দেখবার জো নেই। এ তো শুনলে, সব একের খেলা আবার প্রত্যেকটিকেই আলাদা আলাদা দেখতে পাওয়া যায়। দেহীরূপে এক রকম হয়ে আছেন; আবার মনরূপে তারই সঙ্গে আর এক রকম হয়ে রয়েছেন; আবার আর এক রকম হয়ে উভয়কে আলাদা দেখছেন। অদ্ভুত খেলা!

পা। দেহীর সঙ্গে মন কিভাবে আছে? আর মনকে ও দেহীকে পৃথকভাবে যে দেখছে, সে কে?

ভ। মন দেহীর সঙ্গে কেমন ভাবে আছে জান? যেমন দুধের সঙ্গে জল আছে, কি ঘি আছে।

মনকে ও দেহীকে যে ভিন্ন বস্তু বলে দেখে, সে কে জান? সে ঐ দেহী। সে আপনাকে আপনি দেখে। সে এত দিন মনকে সঙ্গে নিয়ে, তার গায়ে কাদা মাখিয়ে খেলছিল; এখন সে খেলা বন্ধ করে গায়ের ময়লা ধুয়ে, মনকে বিমল করে তার ভিতর দিয়ে আপনাকে আপনি দেখছে। এও তার আর একরকম খেলা।

যখন আপনাকে আপনি দেখে, তখন এ দেখাটাকে সাধুলোক আত্মদর্শন বলেন। মনকে সঙ্গে নিয়েই এ দর্শনটি হয়। এখন মনের ইন্দ্রিয়-ঘোড়াগুলো আর নেই। এখানে একটা মজার কথা শোন - এ যে একটা 'আমি' আজীবন 'আমি' 'আমি' বলে তর্জন গর্জন কচ্ছিল, সে আমিটা ঐ সময়ে এমন পালায় যে, তার গন্ধমাত্র থাকে না। ত্রিভুবন খুঁজলেও কোথাও তাকে দেখতে পাবে না।

পা। আপনার কথামত আত্মদর্শন মানে জীবাত্মার স্ব-স্বরূপদর্শন। আচ্ছা, এ দর্শন কি চক্ষুর দ্বারা হয়?

ভ। না, বোধ দ্বারা।

পা। এ দর্শন সাকার কি নিরাকার?

৭১

ভ। একরকম দেখায়, সে কি - মুখে বলতে পারলুম না। তবে সে-সময়ের অবস্থার আভাস দিতে পারি। যে লোক এই দর্শন করেন, তখন তাঁর অবস্থা কেমন জান? - যেমন একজন গাঁজায় দম দিয়ে ভোঁ হয়ে বসে আছে। এখানে মনের ঘোড়ার খেলা একদম বন্ধ। সে খেলা যেন কখনো ছিল না। এখানে সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ কিছুই নেই। এ রাজ্য মহাশান্তির রাজ্য, তা সে যতক্ষণের জন্যেই হোক না।

পা। এ অবস্থায় ভগবানকে কিরূপ দেখায়?

ভ। ঠাকুর বলতেন, একবার রাম হনুমানকে জিজ্ঞেস করেন, হনুমান, তুমি আমাকে কি রকম দেখ? হনু বললেন, হে রাম, তোমাকে কখনো দেখি মহাগ্নি, আর আমি তার একটি ফিনকি; কখনো দেখি তুমি প্রভু, আমি দাস; আবার কখনো দেখি তোমায় আমায় ভেদ নেই। এখানে ভগবানকে মহাগ্নি দেখায়।

পা। জীবন্মুক্ত অবস্থায় মানুষ কিভাবে সংসারে থাকে?

ভ। সে সংসারে ভেসে বেড়ায়, তার ভিতর আর জল ঢোকে না। সে সংসারের সুখ-দুঃখে চঞ্চল হয় না, ধ্রুবতারা-ভগবানের লক্ষ্যটি হারায় না। তার দেহখানা যে দিকেই টলুক না কেন, মনখানা ঠিক একেবারে কম্পাসের কাঁটার মতো ঈশ্বরের পাদপদ্মের দিকে আঁটা থাকে। এ পরম শান্তির অবস্থা। ভগবানের অপার কৃপা না হলে মানুষ এ অবস্থা পায় না। এ জীবন্মুক্তির অবস্থায় 'আমি'-টা একেবারে যায় না, একটুকু থাকে, কিন্তু সে মরা-'আমি' হয়ে থাকে।

পা। মনখানা ষোল আনা রামকৃষ্ণদেবের ভেতরে গেলেই যদি সব লেঠা মিটে যায়, তাহলে কি করে শীঘ্র মনখানা তাঁতে যায়? এর উপায় কি? এখন মনটাকে দেখছি ঠিক মাছির মতো মধুতেও বসছে, আবার ময়লাতেও বসছে।

৭২

ভ। আগে একেবারেই মধুর ধার দিয়েই যেত না, কেবল ময়লাতেই থাকত। এখন যাঁর কৃপায় মধুর স্বাদ পেয়েছে, তাঁরই কৃপায় সময়ে মৌমাছির মতো স্বভাব পেয়ে অবিরত মধুতেই থাকবে! তুমি এখন তাঁতে লেগে থাক। তাহলেই সব হয়ে যাবে। ঠাকুর একটি গান করতেন,

হরিসে লাগি রহরে ভাই!
তেরা বনত বনত বনি যাই॥
অঙ্কা তারে, বঙ্কা তারে, তারে সুজন কসাই,
শুগা পড়ায়কে গণিকা তারে, তারে মীরাবাঈ॥
দৌলৎ দুনিয়া মালখাজনা, বেনিয়া বয়েল চালাই,
এক বাৎসে ঠাণ্ডা পড়েগা, খোঁজ খবর না পাই॥
য়্যাসি ভক্তি কর ঘট ভিতর, ছোড় কপট চতুরাই,
সেবা বন্দি আউর অধীনতা, সহজে মিলি রঘুরাই॥

ঠাকুর আর একটি সুন্দর উপমা দিতেন। বর্ষাকালে মাঠ একেবারে ডুবে যায়, তখন মাঠ আর দেখা যায় না; মাঠ যেমন পুকুর! তখন মাঠ কি করে? মাঠ কেবল রাতদিন আকাশপানে তাকিয়ে চুপ করে পড়ে থাকে; সময়ে দেখতে পায় যে, যে জল তাকে ডুবিয়ে রেখেছিল, সে জল আর নেই, সব শুকিয়ে গেছে। তুমিও তেমনি রামকৃষ্ণদেবের মুখপানে তাকিয়ে বসে থাক; সময়ে দেখতে পাবে যে, যে কামকাঞ্চনের রস তোমার মনকে ডুবিয়ে রেখেছে, সে রস আর নেই।

ঠাকুর আর একটি কথা বলতেন - হে জীব! তোমার দুটি হাত, একটি ঈশ্বরের পাদপদ্মে রাখ, আর একটি সংসারে রাখ, যার বেশি জোর, সে পরে টেনে নেবে।

পা। পরমহংসদেবের কথাগুলি কি সুন্দর! যতক্ষণ এঁর কথা শুনি ততক্ষণ কোন কিছুই মনে থাকে না। মনটা যেন তাঁর কথায়

৭৩

একেবারে ডুবে থাকে। এ বয়সে অনেক রকমের কথা শুনেছি, কিন্তু এমন মন-মজানো কথা কোনটিই নয়। যত শুনছি, তত আরও শুনতে মন যাচ্ছে, অথচ হাতে যে কি নগদ পাচ্ছি, তা তো কিছুই বুঝছি না আর যেসব কথা শুনছি, তাও যে কতদূর বুঝছি, তাও জানি না।

এখন একটা কথা জিজ্ঞেস করি, সেই জীবন্মুক্তির কথা বলতে গিয়ে বললেন, 'আমি'-টা মরে যায়, কিংবা যদিই একটুকু থাকে, সে মরা-'আমি'ই হয়ে থাকে। কথাটা কি বলুন দেখি?

ভ। এ কথাটা মনের কথার চেয়েও শক্ত, ঠাকুরের কৃপায় যতটুকু দেখছি, বলি শোন।

ছেলেবেলা থেকে মানুষ যে এই 'আমি' 'আমি' রব ধরে, এটা বড় সর্বনেশে রব। জুজু বলে ভয় দেখালে ছেলেরা যেমন ভয় পায়, অথচ জুজু বলে একটা কোন জিনিস নেই, তেমনি 'আমি' 'আমি' বলে মানুষ যে চিৎকার করে বেড়ায়, 'আমি' বলে কিন্তু কোন একটা জিনিসই নেই। ছেলে বড় হলে যেমন বুঝতে পারে যে জুজু একটা ভয়-বাচক শব্দ মাত্র, তেমনি মানুষের জ্ঞান হলে সে বুঝতে পারে, 'আমি' একটা অহঙ্কার-বাচক শব্দমাত্র - জুজুর মতো অলীক, মিথ্যা।

পরমহংসদেব বলতেন, 'আমি'-টা কেমন জান? - যেমন পিঁয়াজটি। পিঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে যেমন পিঁয়াজে আর পিঁয়াজ থাকে না, তেমনি শরীরটা ধরে বিচার করতে গেলে 'আমি'কে আর পাওয়া যায় না।

মানুষ যে এত বিশ-বাঁও জলে পড়েছে, মানুষ যে সিদে পথ ছেড়ে গোলকধাঁধার ভিতর ঢুকেছে, মানুষ যে এমন শুষ্ক ডাঙায় বাস করে অকূল জলে ভাসছে, এর মূল কারণ এই - নাই-'আমি'কে আছি-'আমি' জ্ঞান করা। 'আমি'-জ্ঞানটি যে পুরো অজ্ঞান ও অবিদ্যার

৭৪

বন্ধন, এ জ্ঞানটি হলেই তার ধোঁকার টাটী ভেঙে যায়; তার ধর্মাধর্ম, পাপ-পুণ্যের ধাঁধা ছুটে যায়; তার শুচি-অশুচি সমান হয়; তার গলার হার গলায় রয়েছে, সে দেখতে পায়; তার পূজা জপ ক্রিয়াকাণ্ড সব ঘুচে যায়; তার বিশ্বময় হরিদর্শন হয়; আর যা কিছু হয়, তা সে অবস্থায় না পড়লে, কেউ বুঝতে পারে না।

আমি অমুকের ছেলে, আমি অমুক, আমাকে জানিস না - এসব কথা যে-'আমি' বলে, সে-আমিটি মিথ্যা নয় বটে, কিন্তু বস্তুতঃ সে-আমি কে জান? সে-আমি - তিনি মাত্র। এ বিষয়টি বিচার-বুদ্ধিতে স্থির করা যায় না, হাজারবার শুনলেও বুঝা যায় না, তবে যখন ভগবান বুঝিয়ে দেন, দেখিয়ে দেন, তখন মানুষ বুঝতে পারে ও 'আমি'-হারা হয়। সৃষ্টিতে একটা বই দুটি জিনিস নেই। এ জীবজগতে যা কিছু দেখছ, সব সেই তিনি। মায়ার কৌশল, বন্ধনে জীব 'আমি' 'আমি' করে। মায়ার এমন মোহিনী খেলা, এ 'আমি'-টি যে তিনি, এ ব্যাপারটা আর জানতেই দেয় না। এ মায়ার খেলায় জীব মুগ্ধ। মায়া জীবকে তাঁর খেলা প্রাণান্তেও দেখতে দেন না! এ মায়া দ্বিবিধ ভাবে খেলা করছেন। এক বিদ্যা-মায়া আর এক অবিদ্যা-মায়া। যেসব জীব অবিদ্যা-মায়ার রাজ্যগত তারা কাম-কাঞ্চন নিয়ে গুরুহারা হয়ে বেহুঁশ হয়ে খেলছে। এরা মায়ার কোন খেলাই দেখতে পায় না। এদের দিন-রাত এক ধারা বইছে। আর যারা ভগবানের কৃপায় বিদ্যা-মায়ার অন্তর্গত, তাদের মায়া নিজের খেলা দেখিয়ে দিয়ে খেলাতে খেলাতে ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন। এমন জীব কোটির মধ্যে একজনও দুর্লভ। এমন একজন যদি মেলে, সে মায়ের বরপুত্র। এটি জেনো, ইনি বরপুত্র হলেও হাসি-কান্নার খেলা থেকে মুক্ত নন। যতদূর খেলা ততদূর মায়ার রাজ্য। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর থেকে কীটাণুকীট পর্যন্ত মায়ার ঘূর্ণিপাকে সব ঘুরছেন। মায়ার বন্ধন কেমন জান? - আভাসে যেমন রবারের গোলাকার

৭৫

দড়ি। যে বস্তুকে বাঁধে, সেটা যতই মোটা হোক না কেন, দড়ির আয়তন ততই বৃদ্ধি হয়; আবার সেটা যতই সরু সূক্ষ্ম হোক না কেন, দড়ির আয়তন ততই সরু ও সূক্ষ্ম হয়। বস্তু যতই সূক্ষ্ম হোক, বন্ধনের মধ্যেই থাকতে হবে। এ বন্ধনের পর যে কি, তা আমি জানি না ও তার কিছুটা আভাসও জানি না। যিনি যতই বরপুত্র হোন না কেন, বাঁধনের হাতে মুক্তি নেই। তবে বরপুত্রের বাঁধন প্রার্থনীয় ও দেবেশবাঞ্ছিত। কেন না, এ বাঁধনে সুখ বই দুঃখ নেই। এঁরা মায়ার খেলা দেখতে দেখতে যান। এখানেও অবিদ্যার বন্ধনের মতো মনের হাসি-কান্না আছে বটে, কিন্তু এ হাসি-কান্না আর এক রকমের। এতে বেহুঁশ করে না, আর একটা মজা আছে। এসব মায়ার খেলা; মায়ার কৃপায় এ খেলা দেখবার জিনিস - শোনবারও নয় আর বলবারও নয়।

'আমি'-র কথা হচ্ছিল। মায়া এ 'আমি'-টিকে আর দেখতে দেয় না আর 'আমি'-ও একেবারে যায় না। রামকৃষ্ণদেব জীবকে এসব খবর জানিয়ে দেবার জন্য অনেক সাধনা করেছিলেন, আর মধ্যে মধ্যে বলতেন, 'নাহং নাহং, তুহুঁ তুহুঁ', অর্থাৎ 'আমি নই, আমি নই, তুমি - তুমি!' জীব 'আমি' ছেড়ে, 'তুমি তুমি' কখন বলে, রামকৃষ্ণদেবের কথিত একটি উপমা বলি শোন।

গরু পশুজাতি। বাছুরটি প্রসব হবামাত্র হাম্বা হাম্বা রব ধরে। হাম্বা হাম্বা মানে - হাম্ হে হাম্ হে অর্থাৎ 'আমি আমি'। বড় হলে চাষা লাঙলে বা গাড়িতে যুতে দিন-রাত খাটায়, তবু 'আমি' রবটি ছাড়ে না। বুড়ো হলো, অস্থিচর্মসার হলো, খাটুনির বিরাম নেই, তবু রবটি ছাড়ে না। তারপর মরে গেল; চামড়াটা নিয়ে চেঁছে ছুলে, পিটিয়ে, টেনে ঢাক ছাইলে; সেই চামড়া ঐ অবস্থাতেও বাজালে হাম্ হাম্ করে, রবটি আর ছাড়ে না। সব শেষে শিরা, আঁত ইত্যাদি নিয়ে তায় ক্রমাগত পাক দিয়ে দিয়ে তাঁত তৈরি

৭৬

করে। তখন সে অবস্থাতেও তার ভিতরে 'আমি' থাকে। তারপর ধুনুরী যখন তার যন্ত্রে তারসংযোগ করে টান দিয়ে বাজায়, তখনও ক্ষীণ স্বরে 'আমি' 'আমি' রব করে। সকলের শেষে যখন জানু পেতে বসে যন্ত্রটি ধরে ডান হাতে মুগুর নিয়ে বার বার সেই তাঁতের উপর প্রবলবেগে ঘা মারে, তখন সে সেই চিরকেলে 'আমি' রবটি ছাড়ে আর তুহুঁ তুহুঁ করে। জীবকে এই রকম খাটিয়ে, বাইয়ে, মুখ দিয়ে রক্ত উঠিয়ে, উদ্ব্যস্ত করে ধন জন মান ছাড়িয়ে নিয়ে ক্রমাগত শোকে তাপে যদি জর্জরিত করা হয়, তখন সে আর 'আমি' 'আমি' করে না - বলে, হে ভগবান, 'তুমি' 'তুমি'। জীব এরকম দুর্দশাগ্রস্ত না হলে, ঐ যে বজ্জাত আমি তার ভিতর ঢুকেছে, সে-আমি আর যায় না। এ 'আমি' স্বয়ং মূর্তিমতী মায়া।

পা। আপনি পূর্বে বললেন যে, 'আমি' নামে যে জিনিসটি, সেটি আমি নয়, সেটি তিনি। আবার এ আমিকেই বজ্জাত আমি বলছেন, তাহলে তিনি বজ্জাত হলেন কি করে?

ভ। মায়ার ভয়ঙ্কর খেলা। যতদিন না ঈশ্বরলাভ হয়, ততদিন পাপপুণ্য, ভালমন্দ, সৎ-অসৎ এসব দ্বন্দ্বভাব থাকে। আর ঈশ্বরলাভ হলে মন্দ কি বজ্জাত বলবার কিছু থাকে না। বজ্জাত 'আমি' কতদিন থাকে জান? যতদিন ঐ পাকা 'আমি'-কে না দেখতে পাওয়া যায় ততদিন। তাকে দেখতে পেলে আর বজ্জাত থাকে না। বজ্জাত অবস্থায় 'আমি' অহঙ্কারে পরিপূর্ণ থাকে। এ অহঙ্কার - মায়া। এ অহঙ্কার নষ্ট হলেই ঐ আমিটি 'তুমি' হয়। 'আমি' যখন 'তুমি' হয়, তখন তার আর মায়া-অহঙ্কার থাকে না। 'আমি'-কে চিনতে পারলে অহঙ্কার এমন পালায় যে, আর তাকে ত্রিভুবন খুঁজলেও দেখতে পাওয়া যায় না। রামকৃষ্ণদেব মধ্যে মধ্যে বলতেন, দেখ, 'আমি'-টিকে খুঁজতে গেলাম, কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না। সে অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান ভগবান এক হয়েও মায়াকে সঙ্গে নিয়ে